Shadow

ভোলায় শুঁটকি উৎপাদনে আগ্রহ বাড়ছে

ভোলা প্রতিনিধি ॥ দ্বীপজেলা ভোলার চরফ্যাশন ও মনপুরায় লক্ষাধিক মানুষ মৎস্য ব্যবসার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। নদী-সাগরে মাছ ধরে যুগের পর যুগ পার করছেন তারা। বছরের অর্ধেক সময় ইলিশ মাছ আহরণ করলেও বাকি সময় পার করছেন তারা শুঁটকি ব্যবসায়। বর্তমানে এ পেশায় জড়িতরা এখন স্বাবলম্বী। নভেম্বর-মার্চ এ সময়ে উৎপাদন বেশী হয়। সঠিক ব্যবস্থাপনা ও সরকারি সহায়তা পেলে বৃহদাকারে শুঁটকি উৎপাদন সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, বছরের আশ্বিন, চৈত্র ছয় মাস মূলত শুঁটকির মৌসুম। এ সময়ে বেকার জেলেরা সাগর থেকে ছোট ছোট বিভিন্ন প্রজাতির মাছ রোদে শুকিয়ে আড়তে বিক্রি করেন। আড়তদাররা প্রস্তুত করা শুঁটকি জেলা শহর ছাড়াও ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, বগুড়া, ময়মনসিংহ, লক্ষ্মীপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করেন। এর মধ্যে কিছু শুঁটকি মানুষের খাওয়ার জন্য, বাকি শুঁটকি বিভিন্ন প্রাণীর খাবার হিসেবে তৈরি করা হয়।
স্থানীয় সূত্রে আরো জানা যায়, জেলার দক্ষিণের চরফ্যাশন উপজেলার ঢালচর ইউনিয়নের পূর্ব ঢালচর, কুকরি-মুকরি ইউপির চর পাতিলা, চর মানিকা ইউনিয়নের চর কচ্ছপিয়া, হাজারীগঞ্জের চর ফকিরা এবং দুলার হাট থানার আশার চরে শুঁটকি উৎপাদন হচ্ছে কয়েক বছর ধরে। নতুন করে চরফ্যাশনের আসলামপুর ও চরমাদ্রাজ ইউনিয়নে শুঁটকি তৈরি হচ্ছে। মুজিবনগর ইউনিয়নেও শুঁটকি উৎপাদনের পরিকল্পনা চলছে। এছাড়া মনপুরা উপজেলার দুটি ইউনিয়নে আট-নয় বছর চলছে শুঁটকি উৎপাদন।
শুঁটকি উৎপাদনে জড়িতদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নদী ও সাগর থেকে মাছ ধরার পর দুই-তিনদিন ভালোভাবে শুকিয়ে মাচায় কিছুদিন সংরক্ষণ করতে হয়। পরে উৎকৃষ্ট মানের শুঁটকি প্রস্তুত হলে তা বিক্রির জন্য নেয়া হয়।
দুলার হাট মাছবাজারের শুঁটকি আড়তদার মো. আব্বাস মিয়া বলেন, শুঁটকির জন্য এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় বাজার এটি। এ বাজার থেকে প্রতিদিন বিভিন্ন জেলায় ৫০-৬০ টন শুঁটকি বেচাকেনা হয়। অধিকাংশ শুঁটকি প্রাণীর খাদ্য তৈরির কাজে ব্যবহূত হয়। এর মধ্যে কোনোটির কেজি ৪০-৪৫ টাকা, রকমভেদে ৬০-৬৫ টাকা দরেও বিক্রি হচ্ছে। মানুষের খাওয়ার শুঁটকি বিক্রি হয় কেজিপ্রতি ১০০-১২০ টাকা দরে। কোনো কোনো সময় এ দর ওঠানামা করে।
ব্যবসায়ী আবদুস সালাম বলেন, শুঁটকি মৌসুমের এ সময়ে ১ হাজার ৮০০ টাকায় প্রতি মন বিক্রি হয়। সর্বনিম্ন ৪০ টাকা কেজি দরে হলেও দাম দাঁড়ায় ৭২ লাখ টাকা। সেই হিসাবে মৌসুমে কয়েক কোটি টাকার শুঁটকি বেচাকেনা হয় শুধু এ বাজারেই।
স্থানীয় ব্যবসায়ী মো. বাবুল ব্যাপারী বলেন, গত ছয়দিন আমার চাতালে প্রতি মণ শুঁটকি ১ হাজার ৬০০ টাকায় বিক্রি করেছি। আমি ৪০০ মণ শুঁটকি বিক্রি করে মোটামুটি ভালোই লাভ করেছি।
চরফ্যাশন উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মারুফ হোসেন মিনার জানান, এখানে সাধারণত চেউয়া মাছের শুঁটকি বেশি হয়। এছাড়া রূপচাঁদা, লইট্যা, অনুফা, কাঁচকি মাছেরও শুঁটকি হয়। বিশেষ করে কুকরি-মুকরির চর পাতিলা, মনুরা, ঢালচরের পূর্ব ঢালচর শুঁটকির জন্য বিখ্যাত। এ শুঁটকিতে প্রোটিনের পরিমাণ বেশি হওয়ায় মাছের ফিশফিড তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। মাছ চাষের সময়ে এসব শুঁটকির ব্যাপক দাম পাওয়া যায়।
একই চিত্র দেখা যায়, মনপুরা উপজেলার মনপুরা ইউনিয়ন ও দক্ষিণ সাকুচিয়া-এ দুটি ইউনিয়নে। সেখানেও প্রায় ২০ হাজার মানুষ শুঁটকিপল্লীতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছে। মনপুরার দক্ষিণ সাকুচিয়া ইউনিয়নের রহমানপুর গ্রামের শুঁটকিপল্লীতে কাজ করা সাইফুল্লা, সবুজ, মোসলেউদ্দিন, শাজাহানসহ আরো অনেক শ্রমিকের সঙ্গে কথা হলে তারা বলেন, বর্তমানে নদীতে ইলিশের পরিমাণ কম। অধিকাংশ জেলে-মাঝিরাই এখন শুঁটকি ব্যবসায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। শুঁটকি ব্যবসায়ী নাজিমুদ্দিন বলেন, কোনো কোনো বছর কম লাভ হলেও এ ব্যবসায় কখনো লোকসান গুনতে হয়নি। অধিকাংশ সময় ভালোই মুনাফা হয়।
মনপুরা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ভিক্টর বাইন বলেন, সম্প্রতি মনপুরায় শুঁটকির ব্যাপক সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। মনপুরার দক্ষিণ সাকুচিয়া ইউনিয়নের রহমানপুর গ্রামে সবাই শুঁটকি উৎপাদন করে। এছাড়া মনপুরা ইউনিয়নের কলাতুলি চরেও শুঁটকি তৈরি হয়ে আসছে। প্রতি বছর এর চাহিদা বাড়ছে। তাই উৎপাদনও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সরকারের পক্ষ থেকে এসব ব্যবসায়ীকে পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি এ কাজে আরো সফলতার জন্য বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে ট্রেনিংয়ের আওতায় আনার কথা জানান জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এসএম আজহারুল ইসলাম। তিনি বলেন, শুধু সরকারের পক্ষ থেকে নয়, বিভিন্ন এনজিও সংস্থাকে এসব ব্যবসায়ীর পাশে দাঁড়ানো উচিত। ভোলার উৎপাদিত শুঁটকি শুধু দেশের বাজারে নয়, আন্তর্জাতিক বাজারের স্বীকৃতি পাওয়া সম্ভব হবে বলে আমি মনে করছি।