Shadow

রাঙ্গামাটিতে বিলুপ্ত প্রায় বাঙালির ঐতিহ্য পালকি

প্রয়াস নিউজ,রাঙ্গামাটি : দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মত পাহাড়েও বাঙালির ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন বাহন পালকি। এর শব্দটি সংস্কৃত ‘পল্যঙ্ক’ কিংবা ‘পর্যঙ্ক’ পালি ভাষায় এবাহনের নাম ‘পালাঙ্কো’ হিন্দি ও বাংলায় পালকি নামে পরিচিত। অনেক জায়গায় এ বাহনকে ডুলি, শিবিকা ইত্যাদি বলা হয়। পর্তুগিজরা এর নাম দেয় ‘পালাঙ্কুয়নি’।
বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা এবং চর্তুদশ শতকের পর্যটক জন ম্যাগনোলি ভ্রমণের সময় পালকি ব্যবহার করতেন বলে জানা যায়। সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে এবং পরবর্তী সময়ে সেনাধ্যক্ষদের যাতায়াতের অন্যতম বাহন ছিল পালকি।
আধুনিক যানবাহন আবিষ্কৃত হওযার আগে অভিজাত শ্রেণির মানুষ পালকিতে চড়েই যাতায়াত করতেন। বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে বিয়েতে ও অন্যান্য শুভ অনুষ্ঠানে বর ও কনের জন্য পালকি ব্যবহারের প্রথা চালু ছিল। এছাড়া অসুস্থ রোগীকে চিকিৎসালয়ে নেয়া-আনার জন্যও পালকি ব্যবহৃত হতো।
পালকি বিভিন্ন আকৃতি ও ডিজাইনের হয়ে থাকে। সবচেয়ে ছোট ও সাধারণ পালকি (ডুলি) দু’জনে বহন করে। সবচেয়ে বড় পালকি বহন করে চার থেকে আটজন পালকি বাহক। পালকি বাহকদের বলা হয় বেহারা বা কাহার।
হাডি, মাল, দুলে, বাগদি, বাউডি প্রভৃতি সম্প্রদায়ের মানুষ পালকি বহন করেন। বেহারারা পালকি বহন করার সময় নির্দিষ্ট ছন্দে পা ফেলে চলে। পালকি বহনের সময় তারা বিশেষ ছন্দে গানও গান। তাদের চলার গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে গানের তাল পরিবর্তিত হয়।
বাংলায় সতেরো ও আঠারো শতকে ইউরোপীয় বণিকরা হাটে-বাজারে যাতায়াত এবং তাদের মালপত্র বহনের জন্য পালকি ব্যবহার করত। তারা পালকি ব্যবহারে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়ে যে, কোম্পানির একজন স্বল্প বেতনের সাধারণ কর্মচারীও এদেশে যাতায়াতের জন্য একটি পালকি রাখত ও তার ব্যয়ভার বহন করত। কিন্তু পালকির ব্যয় বহন করতে গিয়ে কর্মচারীরা অবৈধ আয়ের নানাবিধ পন্থা অবলম্বন করতে থাকে। ফলে কোর্ট অব ডিরেক্টরস ১৭৫৮ খ্রিস্টাব্দে সাধারণ কর্মচারীদের পালকি ক্রয় ও ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন।
উনিশ শতকের প্রায় মাঝামাঝি সময় দাস প্রথা বিলোপের পর বিহার, উড়িষ্যা, ছোটনাগপুর ও মধ্যপ্রদেশ থেকে পালকি বাহকরা বাংলায় আসতে থাকেন। বহু সাঁওতাল পালকি বাহকের কাজ নেয়। শুষ্ক মৌসুমে তারা নিজেদের এলাকা থেকে এদেশে আসত এবং বর্ষা মৌসুমে আবার চলে যেত। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমের শেষে তারা নির্দিষ্ট কয়েকটি এলাকায় যেত এবং কোথাও কোথাও অস্থায়ী কুঁড়েঘর বানিয়ে সাময়িক আবাসের ব্যবস্থা করে নিত।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে যাতাযাতের মাধ্যম হিসেবে স্টিমার ও রেলগাড়ি চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পালকির ব্যবহার কমতে থাকে। ক্রমশ সড়ক ব্যবস্থার উন্নতি এবং পশুচালিত যান চালু হলে, যাতায়াতের বাহন হিসেবে পালকির ব্যবহার প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৩০ সালে শহরাঞ্চলে রিকশার প্রচলন শুরু হওয়ার পর থেকে পালকির ব্যবহার উঠে যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *