Shadow

কিংবদন্তি নায়িকা সুচিত্রা সেন বাংলা চলচ্চিত্রের রূপালী পর্দায়

ইব্রাহীম খলীল,পাবনা জেলা প্রতিনিধি : বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি নায়িকা সুচিত্রা সেন রূপালী পর্দায় উত্তম-সুচিত্রা সেন জুটি আজও তুমুল দর্শক প্রিয়। জন্মসূত্রে তিনি বাংলাদেশি। ১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল তিনি পাবনা শহরের হেমসাগর লেনের বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন।

তার স্মৃতি বিজরিত পাবনা শহরের হেমসাগর লেনের পৈত্রিক বাড়িতে স্মৃতি সংগ্রহশালা গড়ে না ওঠায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন জেলার সাংস্কৃতিককর্মীরা।

দুই বাংলার মহানায়িকা সুচত্রিা সেন । যার অভিনয় আজও দাগ কাটে চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মনে। নিজের রুপ আর অভিনয় দক্ষতা দিয়ে হয়ে উঠেছিলেন কিংবদন্তি। তাকে হারিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রের যে শুন্যতা তা কি পূরণ হবে কখনও?

পাবনা শহরের হেমসাগর লেনের এই বাড়িতে কেটেছে মহানায়িকার শৈশব কৈশর। বাড়িটির প্রতিটি কোনায় ছড়িয়ে আছে সুচিত্রা সেনের স্মৃতি। লেখাপড়া করেছেন শহরের দু’টি স্কুলে। তার মৃত্যুর তিন মাসের মাথায় বাড়িটি অবৈধ দখল থেকে উদ্ধার হলেও, আজও সেখানে গড়ে উঠেনি উন্নত কোন স্মৃতি সংগ্রহশালা। এ নিয়ে আক্ষেপের শেষ নেই জেলার সাংস্কৃতিককর্মীদের মাঝে।

সকল জটিলতা কাটিয়ে পৈত্রিক বাড়িতে সুচিত্রা সেনের স্মৃতি সংগ্রহশালা গড়ে তোলা হলে তার স্মৃতি ধরে রাখা সম্ভব বলে মনে করেন পাবনাবাসী।

রমা থেকে সুচিত্রা সেন হয়ে মিসেস সেন, আর তারপর মহানায়িকা, এ যাত্রাপথে অন্যতম পাথেয় কিন্তু ছিল সুচিত্রা সেনের অপার্থিব ভুবনমোহিনী রূপ।

বাংলা চলচ্চিত্রে চিরদিনের, চিরকালের অবিস্মরণীয় এক বিস্ময় মহানায়িকা সুচিত্রা সেন। বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রে অভিনয় করে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তিনি।

সুচিত্রার জন্মসূত্রে পাওয়া নাম রমা দাসগুপ্ত। ১৯৪৭ সালে শিল্পপতি আদিনাথ সেনের ছেলে দিবানাথ সেনের সঙ্গে বিয়ে হয় রমার। স্বামীর নামের সঙ্গে মিলিয়ে শেষের দাশগুপ্ত কেটে বসল সেন। দেশভাগের কিছুদিন আগে স্বামীর সঙ্গে কলকাতায় চলে যান রমা সেন। স্বামী দিবানাথ সেনের ইচ্ছেতেই রমা সেনের চলচ্চিত্রে আসা।

সুচিত্রা অভিনীত প্রথম সিনেমার নাম ‘শেষ কোথায়’। এ অমুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমার মধ্য দিয়ে তার চলচ্চিত্র জীবনের শুরু হয়েছিল। এ সিনেমার শুটিংয়ের এক পর্যায়ে চলচ্চিত্র পরিচালক সুকুমার দাশগুপ্ত বললেন, রমা নাম পাল্টাতে হবে। সে সময় সিনেমার সহকারী পরিচালক নিতিশ রায় বললেন, ‘সুচিত্রা সেন’। চলচ্চিত্রে রমা উদয় হলেন সুচিত্রা নামে। নামকরণের সময় নীতিশ রায়ও ভাবতে পারেননি একদিন ওই নামটাই বাঙালির আধুনিক রোমান্টিকতার সমার্থক হয়ে দাঁড়াবে।

রূপালি পর্দার উত্তম-সুচিত্রা জুটি আজও তুমুল দর্শকপ্রিয়। সুচিত্রা উত্তম কুমারের বিপরীতে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ সিনেমাতে প্রথম অভিনয় করেন। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। সিনেমাটি বক্স অফিসে সাফল্য লাভ করে এবং উত্তম-সুচিত্রা জুটি একের পর এক হিট সিনেমা উপহার দিতে থাকেন। মহানায়ক উত্তম কুমারের সঙ্গে তার চিরসবুজ জুটি বাংলা প্রেমের সিনেমাকে স্বর্ণযুগে পৌঁছে দিয়েছিল। নিজস্ব স্টাইলটা রপ্ত করেছিলেন অভিনয়ের প্রতি নিষ্ঠা, ধৈর্য আর সাহস নিয়ে। নিজেকে কীভাবে চরিত্রের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হবে সে কথা ভালোভাবেই বুঝতেন তিনি।

১৯৫৪ সালে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ সিনেমার মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্র জগতে সুচিত্রা সেনের জয়যাত্রা শুরু। তার অভিনীত বাংলা সিনেমার সংখ্যা ৫০ এর অধিক। এ ছাড়া ৭টি হিন্দি সিনেমাতে তিনি অভিনয় করেছেন। উত্তম কুমার ছাড়াও সুচিত্রা সেন বিকাশ রায়, বসন্ত চৌধুরী, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অশোক কুমার এবং হিন্দিতে দিলীপ কুমার, দেব আনন্দ, ধর্মেন্দ্র ও সঞ্জীব কুমারের সঙ্গে অভিনয় করেছেন।

১৬ বছরের দাম্পত্যজীবন শেষে সুচিত্রা সেন ও দিবানাথ সেন আলাদা হয়ে যান। স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার সময় তিনি অজয় করের বিখ্যাত ছবি সাত পাকে বাঁধা করেছিলেন। সংসারে খুনসুটি, বনিবনা না হওয়া কিংবা স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ নিয়ে সাত পাকে বাঁধাদর মূল কাহিনি। বাসায় স্বামী দিবানাথ সেনের সঙ্গে ঝগড়া করে এসে শুটিংয়ে নায়ক সৌমিত্রের শার্ট ছিঁড়তে হয়েছিল সুচিত্রা সেনকে, এ যেন বাস্তব জীবনেরই গল্প।

১৯৫৫ সালে সুচিত্রার প্রথম হিন্দি সিনেমা ‘দেবদাস’র জন্য পান সেরা অভিনেত্রীর জাতীয় পুরস্কার। অভিনয় করেছিলেন পারুর চরিত্রে। ১৯৭৪-এ ‘আন্ধি’তে অসামান্য অভিনয় করেছিলেন এক রাজনৈতিক নেত্রীর ভূমিকায়। ‘আন্ধি সিনেমার জন্য ফিল্মফেয়ার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছিলেন সুচিত্রা সেন। ১৯৬৩ সালে মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘সাত পাকে বাঁধা’ সিনেমাতে অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পান।

ছাব্বিশ বছরের চলচ্চিত্র জীবন আর সাড়ে তিন দশকের স্বেচ্ছা নির্বাসন যুক্ত করলে যে সংখ্যাটা দাঁড়ায় তার পুরোটাই কিন্তু সুচিত্রার একটানা জনপ্রিয়তা। বছরের পর বছর নিজেকে সব কিছু থেকে গুটিয়ে নিলেও মানুষের হৃদয়ে তার প্রতি ভালোবাসা আর আকর্ষণ থেকেই যায়। তাকে একবার দর্শনের জন্য নামজাদা অভিনয়শিল্পীরাও অপেক্ষা থাকতেন।

১৯৭২ সালে ভারতের রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পদ্মশ্রী পান। ২০০৫ সালে সুচিত্রা সেনকে ভারতের চলচ্চিত্র অঙ্গনের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কার দেওয়ার প্রস্তাব করা হলে সুচিত্রা সেন দিল্লিতে গিয়ে ওই সম্মান গ্রহণ করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন। তার হয়ে এ সম্মাননা গ্রহণ করেন তার মেয়ে মুনমুন সেন। ২০১২ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বাংলাবিভূষণ সম্মাননা দেওয়া হয় তাকে।

উপমহাদেশের বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি নায়িকা সুচিত্রা সেন ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি ৮টা ২৫ মিনিটে কলকাতার বেলভিউ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮২। আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই তবে তিনি তার সিনেমার চরিত্রে মধ্যে আজও বেঁচে আছেন ভক্ত অনুরাগীত হৃদয়ে।

প্রতি বছর ৬ এপ্রিল স্বপ্নের মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের জন্মদিন পাবনায় পালন করা হয়। ১৯৩১ সালের এ দিনে বাংলাদেশের পাবনায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বেঁচে থাকলে তার বয়স হতো ৯১ বছর।