প্রয়াস নিউজ,ঢাকা: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, “দেশে ছোটোখাটো ঘটনা হলেই দেখি হাউকাউ শুরু হয়ে যায়। অথচ একজন সংসদ সদস্যকে হত্যা করার পর কোনো মানবাধিকার সংগঠন বা কেউ কোনো শব্দও করে না। বাংলাদেশ তো একটি অদ্ভূত দেশ দেখি।”
পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
গত ৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় সুন্দরগঞ্জের শাহবাজ গ্রামে বাড়িতে ঢুকে গুলি করে হত্যা করা হয় সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনকে। আওয়ামী লীগের এই সংসদ সদস্যকে খুনের জন্য জামায়াতে ইসলামীকে দায়ী করেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা।
পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে মত বিনিময়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ। জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে এভাবে মৃত্যুবরণ করতে হবে, এটা কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। প্রতিটি এলাকায় এ ব্যাপারে সর্তক থাকবে হবে।”
২০১৫ সালের অক্টোবরে সুন্দরগঞ্জে লিটনের গুলিতে এক শিশু আহত হওয়ার ঘটনায় বেশ কিছুদিন কারাগারে কাটাতে হয় এই সংসদ সদস্যকে। সে সময় তার লাইসেন্স করা অস্ত্রও জব্দ করে থানায় রাখা হয়।
সেই প্রসঙ্গ টেনে শেখ হাসিনা বলেন, “তার (লিটন) বাসা থেকে পুলিশ তুলে নেয়া হয়েছিল। কেন পুলিশ তুলে নিয়ে যাওয়া হলো? তার বিরুদ্ধে একটা অপবাদ দিয়ে তার লাইসেন্স করা অস্ত্র তার কাছ থেকে নিয়ে যাওয়া হল। মনে হল একেবারে পরিকল্পিতভাবে ছেলেটাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হল।”
লিটন হত্যাকাণ্ডকে ‘ষড়যন্ত্রের অংশ’ হিসেবে বর্ণনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “যারা পরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন ধর্মের মানুষকে হত্যা করল, মসজিদে আগুন দিল, মানুষ পোড়াল, তাদের বিরুদ্ধে তো অত বেশি সোচ্চার হতে দেখি না।”
পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “প্রতিটি এলাকায় জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা রাখতে হবে। নাগরিকদের সঙ্গে নিয়ে সব পরিস্থিতি মোকাবেলায় করতে হবে।”
সাম্প্রতিক বিশ্ব প্রেক্ষাপট তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ এখন ‘বৈশ্বিক পর্যায়ে’ পৌঁছে গেছে। অনেক দেশই পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমসিম খাচ্ছে। বাংলাদেশ এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি। কোনোভাবেই আমরা বাংলাদেশকে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র, জঙ্গিবাদী রাষ্ট্র হতে দেব না।”
তিনি বলেন, “বাংলাদেশ নিয়ে গভীর চক্রান্ত ছিল। এখনও যে নাই, তা নয়। আগামী দুবছর বাংলাদেশকে শান্তিপূর্ণ রাখলে আমরা অর্থনৈতিকভাবে অনেক এগিয়ে যাব।”
শেখ হাসিনা বলেন, “যখনই বাংলাদেশের মানুষ ভালো থাকে, দেশের উন্নতি হয়, তখনই যেন আরও বেশি ষড়যন্ত্র শুরু হয়। আমাদের শত্রু বাইরে না, ঘরের শত্রুই বিভীষণ।”
এ প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে-পরে এবং নির্বাচনের বর্ষপূর্তি ঘিরে বিএনপির আন্দোলনের মধ্যে ব্যাপক সহিংসতা ও নাশকতার ঘটনা স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “তেমন কিছু যে আবার ঘটবে না- সে নিশ্চয়তা নেই।”
“আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশ এখন প্রশংসিত হচ্ছে। ওই প্রশংসা শুনে মন গলা, এটা আমার স্বভাব না। সেখানে সন্দেহের কিছু আছে কি না এটা আমাদের দেখতে হবে।”
অনুষ্ঠানের শুরুতেই পুলিশের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া দিয়ে কথা বলেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী এই বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল এবং স্বরাষ্ট্র সচিব কামাল উদ্দিন আহমেদও অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া আরও দশটি অতিরিক্তি মহা-পরিদর্শকের পদ সৃষ্টির অনুরোধ জানান।
প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে এসব দাবি-দাওয়ার বিষয়ে বলেন, “পুলিশের কার্যক্রম পর্যালোচনা, মূল্যায়ন এবং আগামী দিনের কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের কৌশল নির্ধারণের জন্যই এ বৈঠক করা হয়। কিন্তু এখানে বক্তৃতা ও দাবি-দাওয়া উত্থাপন ছাড়া কিছুই করা হয়নি।” আগামীতে এই সভা রুদ্ধদ্বার করার কথাও বলেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এখন দুটি বিভাগ হয়েছে; পদও বেড়েছে। সামঞ্জস্য রেখে যে পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন, তা সরকার করবে।”
চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি শফিকুল ইসলামও নতুন পদ সৃষ্টির পাশাপাশি আলাদা পুলিশ বিভাগ গঠনের কথা বলেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ও কাউন্টার টেরোরিজম বিভাগের প্রধান মনিরুল ইসলাম উন্নত প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, “জঙ্গিবাদ বৈশ্বিক সমস্যা হলেও বাংলাদেশে একটি ‘দেশীয় সংস্করণ’ আছে। তারা বেহেশতের লোভ দেখিয়ে তরুণদের জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ত করে। তবে আমরা তাদের মেরুদণ্ড অনেকটাই ভেঙে দিয়েছি।”
মনিরুল ইসলাম পূর্ণাঙ্গ কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দিয়ে বলেন, “কাউন্টার রেডিকালাইজেশন দরকার। দীর্ঘ সময় ধরে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করে অভিযানে যেতে হবে।”
গতবছর জুলাই মাসে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার ঘটনায় দুই পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হওয়ার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এটাই হচ্ছে কর্তব্যবোধ, যে আপনারা নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও দায়িত্ব পালন করেছেন।”
অতিরিক্তি ডিআইজ হাবিবুর রহমানও প্রশিক্ষণ সক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। গাজীপুরের পুলিশ সুপার হারুন-অর-রশীদ যানবাহনের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন।
প্রয়োজন অনুসারে পুলিশ বাহিনীকে যানবাহন সরবরাহ করা হচ্ছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “ইতোমধ্যে ছয় হাজার ৮৫৬টি গাড়ি কেনার অনুমোদন দেয়া হয়েছে।”
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন পুলিশ মহা-পরিদর্শক একেএম শহীদুল হক। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন অতিরিক্ত মহা-পরিদর্শক মোখলেসুর রহমান। পরে প্রধানমন্ত্রী পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে ছবিও তোলেন।