এম. শরীফ হোসাইন, ভোলা ॥ ঘূর্ণীঝড় জাওয়াদের প্রভাবে হঠাৎ ভারী বর্ষণে বৃষ্টির পানি জমে ভোলার শত শত কৃষকের স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দিগন্ত জোড়া ফসলের ক্ষেত। কোন কৃষকের জমিতে রয়েছে পাকা আমন ধান, কোন কৃষকের জমিতে রয়েছে খেসারি ডাল, শাক-সবজি, সরিষা, গম ও গোল আলু। ফসলও ভালো হয়েছে। কৃষক স্বপ্ন বুনে ফসল বিক্রি করে ধার-দেনা শোধ করবে। কিন্তু সেই স্বপ্নে হানা দেয় অসময়ের ভারী বর্ষণ। নষ্ট হয়ে যায় ফসলের ক্ষেত। যেন ঘূর্ণীঝড়ে কেঁড়ে নিল ক্ষতিগ্রস্ত শত শত কৃষকের লালিত স্বপ্ন। এতে ধার-দেনা ও ব্যাংক থেকে ঋন নিয়ে চাষাবাদ করা শত শত ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক দিশেহারা হয়ে পড়েছে।
জানা গেছে, চলতি মৌসূমে ঘূর্নিঝড় জাওয়াদের প্রতিকুলতায় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উত্তর ভোলার ইলিশা, রাজাপুর, মাঝকাজী, গাগরিয়া, বাহাদুর পুরসহ বিভিন্ন এলাকা। ক্ষতিগ্রস্তের স্বীকার এ অঞ্চলের কৃষি নির্ভও মানুষ। জাওয়াদের প্রতিকূলতার বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে ফসলের ক্ষেত। এই বন্যার ফলে সারাদেশের ঘুর্ণিঝড় কবলিত অঞ্চলের কৃষক ব্যাপক ক্ষতি গ্রস্থের সম্মুখীন হয়েছেন।
উত্তর ভোলার এসব অঞ্চল ঘুরে দেখা যায় বৃষ্টির পানিতে ভেসে গেছে কৃষকের বীজতলা। হাঁটুপানিতে নেমে অসহায়ের মতো বীজতলা হাতড়ালেও হতাশা ছাড়া কিছুই জোটেনি কৃষকের। পানিতে তলিয়ে গেছে বেশির ভাগ কৃষকের ফসল। শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন এ অঞ্চলের কৃষক। ফসলের মাঠ এখন পানির নিচে তলিয়ে আছে। রাজাপুরের কিছু জায়গায় মাঠ উচু থাকলেও শষা, ধনিয়া, রেখা ও পিয়াজের চারাসহ সব ফসল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অনেক জায়গায় মাঠে শুধু কাদামাটি।
বেশির ভাগ কৃষকের ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় তাঁদের একমাত্র সম্বল এখন চাঁপা দীর্ঘশ্বাস বলে প্রকাশ করেন রাজাপুরের জাকির, জাহাঙ্গীর, বিল্লাল ও ইসমাইল। ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠছে অসহায় কৃষকরা। রাজাপুরে একদিকে নদী ভাঙ্গন তারপরে নিম্মমানের কীটনাশক ব্যবহার করে প্রথমবার জাকিরের ফসলের চারা নষ্ট হয়ে যায়। এদিকে আবার বন্যার পানিতে দ্বিতীয় ধাপের রোপনকৃত চারা নষ্ট হওয়ায় পথে বসিয়েছে আমাকে।
এ বিষয়ে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মঞ্জুরুল হাসান বলেন, আমার এরিয়ার মধ্যে ৩৪৫৬ হেক্টর আবাদি জমি রয়েছে। যার মধ্যে ১৬০০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ। বাকী ১৮৫৬ হেক্টর জমিতে এ বছর রবিশস্য চাষ হয়েছে। বর্তমান ঘুর্ণিঝড় জাওয়াদের প্রভাবে এ অঞ্চলের রবিশস্যের গম, আলু, শরিষা, খেশারি ডাল ও তরমুজের বেশিরভাগ ক্ষতির আশংকা করা হচ্ছে। তবে ঘুর্ণিঝড়ের প্রভাব ছাড়াও এবছর এঅঞ্চলে অতিরিক্ত জোয়ারের পানিতে অনেক বীজ তলা নষ্ট হয়েছে বলেও জানান এ কর্মকর্তা।
এছাড়া বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের প্রভাবে ভোলার দৌলতখানে টানা বৃষ্টিতে শত শত হেক্টর জমির আমনধান সহ রবি ফসলের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করছেন কৃষকরা। বৈরী আবহাওয়া ও টানা বৃষ্টি ও দমকা বাতাসে আমনধানের গাছগুলো মাটিতে নুয়ে পড়েছে। নুয়ে পড়া গাছগুলোর নিচেই বৃষ্টির পানি জমে আছে। বৃষ্টির পানি সরানো না গেলে ক্ষতির পরিমাণ বাড়বে বলে জানান একাধিক চাষিরা।
উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের আমনধান ও রবি ফসলের ক্ষেতে গিয়ে দেখা যায়, টানা বৃষ্টির কারণে রবি ফসলের ক্ষেতে পানি জমে আছে। উপজেলার সৈয়দপুর ইউনিয়নের কৃষক মোঃ নবু জানান, বৃষ্টিতে অনেক ধান পড়ে গেছে। অর্ধেক ধান নষ্ট হয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে। এমনিতেই আমরা কৃষি কাজ করে লোকসানে আছি। তবে এবার আমনের ছড়া দেখে লোকসানের কথা ভুলে গিয়ে ছিলাম। আবার ঝড় বৃষ্টির কারণে চাষাবাদের খরচের ধারদেনা কাটিয়ে উঠতে পারব না।
কৃষকের ভাষ্যমতে দৌলতখানে টানা বৃষ্টিতে আমনধানসহ বাঁধাকপি, ফুলকপি, টমেটো, মূলা, বেগুন, কাঁচা মরিচ, লালশাক, ধনেপাতাসহ সকল ধরনের রবি ফসল ব্যাপক নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানান একাধিক চাষি। এতে কৃষকরা আর্থিক ভাবে লোকসান পড়বে।
উপজেলা কৃষি অফিসার মোঃ সুমন হাওলাদার জানান, চলতি মৌসুমে দৌলতখানে ১৭ হাজার হেক্টর জমিতে আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্র ছিল। এ মৌসুমে আবাদ হয়েছে ১৬ হাজার ৫শ হেক্টর জমিতে। আমনের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮৫ হাজার মেট্রিকটন। এ বছর শীতকালীন সবজির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭৫০ হেক্টর জমিতে। এবার ২৫০ হেক্টর জমিতে আবাদ সম্পন্ন হয়েছে। তবে বৃষ্টির কারণে কিছু কিছু এলাকায় ধানসহ রবি ফসলের ক্ষতি হতে পারে। ক্ষতির পরিমাণ এখনও তালিকা করা সম্ভব হয়নি।
অন্যদিকে ভারী বর্ষণে বৃষ্টির পানিতে মনপুরায় ডুবে দুই হাজার একশত পাঁচ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়ে গেছে বলে নিশ্চিত করেছেন উপজেলা কৃষি অফিসের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন। কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, ভারী বর্ষণে জমিতে বৃষ্টির পানি জমে পাকা আমন ধান ২ হাজার হেক্টর, খেসারি ডাল ৫০ হেক্টর, শাক-সবজি ৫০ হেক্টর, গোল আলু ২ হেক্টর, গম ১ হেক্টর ও সরিষা ২ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতি হয়েছে।
আরো জানা গেছে, উপজেলার ৪ টি ইউনিয়নে দেরীতে রোপন করা পাকা আমান ধানের ক্ষেতের ফসল বৃষ্টির পানিতে ডুবে রয়েছে। একই অবস্থা গোল আলু, সরিষা, গম, খেসারি ডাল, শাক-সবজির ক্ষেত। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক জামাল, মামুন, আলমগীর, খোরশেদ, রতন, শানু, রাসেদ, খালেক সহ অনেকে জানান, তারা ধার-দেনা ও ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে চাষাবাদ করেছি। মাঠে ফসলও ভালো হয়। এবার মাঠে উৎপাদিত ফসল বিক্রি করে সকল ধার দেনা পরিশোধ করে ফের মাঠে ফসল উৎপাদন করবে বলে স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু সব শেষ হয়ে যায় বলে কেঁদে দেন অনেকে। অনেকে ঋণ পরিশোধের চিন্তা করেন। তবে তারা সরকারের কাছে কৃষি প্রণোদনা দাবী করেন।
এ ব্যাপারে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আকাশ বৈরাগী জানান, বৃষ্টির পানিতে দুই হাজার একশত পাঁচ হেক্টর ফসলের ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। বিষয়টি উধ্বর্তন কর্মকতাদের অবহিত করা হয়েছে। কৃষি প্রণোদনা এলে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের দেওয়া হবে।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ শামীম মিঞা জানান, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সরকার প্রণোদনা দিলে দেওয়া হবে।
অপরদিকে ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের প্রভাবে উপকূলীয় দ্বীপ জেলা ভোলায় গত দুই দিনব্যাপী বাতাসের সঙ্গে টানা বৃষ্টি পড়ছে। এর ফলে মেঘনা ও তেতুলিয়া নদী উত্তাল হয়ে উঠেছে। এতে নদী তীরবর্তী ও চর চরাঞ্চলের নিম্নাঞ্চল বসতবাড়ি প্লাবিত হয়েছে। দেখা দিয়েছে বিদ্যুৎ বিভ্রাট। সড়কে যান চলাচল কমে আসছে। সদর উপজেলার সদর রোডসহ বাজারগুলোতে মানুষের ভীরও কমে এসেছে। যেন মনে হচ্ছে শীত নয়, এখন বর্ষা মৌসুম। অসময়ে আবহাওয়ার এমন বৈরী আচরণ, টানা বর্ষণে এখানকার জনজীবন একরকম বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
স্থানীয়রা জানান, রোববার সকাল থেকে সোমবার দুপুর পর্যন্ত জেলার বিভিন্ন উপজেলায় বাতাসের সাথে কখনো গুড়ি গুড়ি আবার কখনো মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নদী তীরবর্তী ও চরাঞ্চলের অনেক এলাকার নিম্মাঞ্চল ও বসতবাড়ি তলিয়ে গেছে। এদিকে বঙ্গোপসাগরে মাছ শিকাররত জেলেরা জানিয়েছেন, জাওয়াদের প্রভাবে বঙ্গোপসাগর ও ভোলার নদী উত্তাল রয়েছে। ইতোমধ্যে অনেকে জাল গুটিয়ে গুটিয়ে তীরে ফিরে এসেছেন।
ভোলা জেলা মৎস্যজীবি জেলে সমিতির সভাপতি এরশাদ জানান, তিনিসহ সাগরে মাছ শিকার করা জেলেদের সবাই তীরে ফিরে এসেছেন।
ভোলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী হাসানুজ্জামান জানান, ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের প্রভাবে ভোলার মেঘনা ও তেতুলিয়া নদী এখন উত্তাল রয়েছে। তিনি বলেন, দুই দিনের টানা বৃষ্টির কারনে জেলায় সর্বোচ্চ ৩ দশমিক ২ মিটার পানি প্রবাহিত হচ্ছে। তবে, এখনো তা বিপদসীমা অতিক্রম করেনি।
ভোলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) সুজিত হাওলাদার বলেন, জাওয়াদ এখানে আপাততঃ তেমন প্রভাব ফেলার সম্ভাবনা নেই। শুধুমাত্র বৃষ্টি পড়ছে। রোদ উঠবে আশা করা যায়। তবুও সার্বিক পরিস্থিতির ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মোকাবিলায় আমরা সতর্ক রয়েছি। সব উপজেলায় কন্ট্রোল রুমও খোলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসনের এ কর্মকর্তা।
ভোলা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো: মোতাহার হোসেন বলেন, আবহাওয়ার তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের উপকূলে জাওয়াদের আঘাত হানার সম্ভাবনা কম। তারপরও ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদ মোকাবিলায় সকল প্রকার প্রস্তুতি গ্রহন করা হয়েছে। বিশেষ করে উপকূলীয় জেলা ভোলার ৬৯২ টি আশ্রয় কেন্দ্রকে প্রস্তুতি রাখা হয়েছে। ইউনিয়ন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যাদের সচেতন থাকতে বলা হয়েছে।
ভোলা সচেতন মহল বলছেন, বাংলাদেশ কৃষি নির্ভর দেশ। কৃষির ওপর নির্ভরশীল হয়েই দেশের অর্থের সিংহ ভাগ অর্জিত হয়। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আমাদের দেশের আবহাওয়া অনবরত বদলে যাচ্ছে ফলে কৃষিক্ষেত্রে নানা রকম ফসলের সময়মতো উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। আবহাওয়া পরিবর্তনের সাথে সাথে বাংলাদেশের কৃষির গতি ও প্রকৃতি বদলে যাচ্ছে মারাত্মকভাবে। ভৌগলিক অবস্থানের কারণেই বাংলাদেশের কৃষি প্রতিনিয়ত প্রকৃতির বৈরী পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে এগিয়ে চলছে। অসময়ে খড়া, বন্যার কারণে একদিকে কৃষক হারিয়ে ফেলছে অতি মূল্যবান ফসলসহ নানা জাতের বীজ। অন্যদিকে মাটি হারাচ্ছে ফসলের উৎপাদনশীলতা। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি তথা জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রকোপ বৃদ্ধির ফলে ভোলার কৃষি নির্ভরশীল ক্ষুদ্র কৃষক সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
ভোলার কৃষি ও কৃষকের উন্নয়ন করতে হলে কৃষির এসব সমস্যা নিরূপণ করে, খাদ্য উৎপাদন ও নিরাপত্তার লক্ষ্যে একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা আমাদের জন্য খুব জরুরি। এছাড়াও কৃষিক্ষেত্রে উন্নয়নের লক্ষ্যে টেকসই কৃষি প্রযুক্তির সম্প্রসারণ ও বৈরী আবহাওয়ার সাথে খাপ খাইয়ে পরিবেশবান্ধব কৃষি ব্যবস্থার প্রচলন প্রয়োজন। কৃষি প্রযুক্তির উন্নয়ন ও উদ্ভাবনে আমরা কিছুটা সফল হলেও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করার আধুনিক প্রযুক্তির মারাত্মক অভাব এখনও রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত যেমন-লবণাক্ততা, উচ্চ তাপমাত্রা, খরা কিংবা বন্যাসহিষ্ণু প্রযুক্তির অভাব লক্ষণীয় যা টেকসই কৃষি উৎপাদনের পূর্বশর্ত।