Shadow

ভোলা-বরিশাল ব্রীজ নির্মাণ, সরকারী মেডিকেল কলেজ ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এখন সময়ের দাবী।

এম. শরীফ হোসাইন, ভোলা ॥ ভোলা একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হলেও এটি সম্ভাবনাময় একটি জেলা। এই জেলায় প্রাকৃতিক সম্পদ গ্যাস রয়েছে। ইতিমধ্যে গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। যা ভোলার চাহিদা মিটিয়ে জাতীয় গ্রিডে দেওয়া হচ্ছে। এই গ্যাস সম্পদকে কাজে লাগিয়ে এখানে শিল্প কারখানা গড়ে উঠলে দেশের অর্থনীতি আরো সমৃদ্ধ হবে। ২৯ নভেম্বর দুপুওে শহরের সদর রোডস্থ দি প্যাপিলন হোটেল এন্ড কনভেনশন সেন্টারে এক গোল টেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথি হিসেবে এসব কথা বলেন জেলা প্রশাসক তৌফিক-ই-লাহী চৌধুরী।
তিনি বলেন, ভোলায় গ্যাস ভিত্তিক শিল্প কল-কারখান হলে এখানে অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরী হবে। কিছুটা হলেও বেকারত্ব কবে ভোলার মানুষের। শুধু ভোলার মানুষ নয়; এখানে সারাদেশের হাজারো মানুষেরও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। এতে করে ভোলার অর্থনৈতিক অবস্থা যেমন সমৃদ্ধ হবে, তেমনি জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারবে এখানকার মানুষ।
জেলা প্রশাসক বলেন, ভোলার শিক্ষা ব্যবস্থা সারাদেশের চেয়ে অনেক পিছিয়ে। এ অবস্থা থেকে আমাদের উত্তোরণের একটা পথ, সেটা হচ্ছে মান সম্মত শিক্ষা। আর এ শিক্ষার জন্য ভোলায় সরকারী মেডিকেল কলেজ ও একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা এখন সময়ের দাবী।
তিনি বলেন, ভোলার মানুষের বর্তমানে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন একটি সরকারি মেডিকেল কলেজ ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ ব্যাপারে আমরা সুপারিশ পাঠাবো। আশা করি দ্রুত এই দুটি বড় দাবী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বাস্তবায়ন করে ভোলাবাসীর স্বপ্ন পূরণ করবেন। এছাড়াও ভোলার যেসব সমস্যাগুলো আছে সেগুলো বাস্তবায়নে আমরা চেষ্টা করবো। এ জন্য ভোলাবাসীর সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রয়োজন।
তিনি আরো বলেন, বর্তমানে আমাদের নৈতিক শিক্ষার বড়ই অভাব। নৈতিক শিক্ষার অভাবের কারণেই আমাদের যুব সমাজ আজ বিপথগামী এবং অসামাজিক কার্যকলাপের সাথে যুক্ত হচ্ছে। তারা নানান অপরাধের সাথেও জড়িত হচ্ছে। আগামীর ভবিষ্যত প্রজন্মকে সঠিক পথে আনতে হলে আমাদের সকলকে নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। এছাড়া শিক্ষার্থীরা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বিভিন্ন অপরাধ কার্যক্রমের সাথে যুক্ত হচ্ছে। অযথা ফেসবুকসহ বিভিন্ন সোসাল মিডিয়ায় সময় ব্যয় না করে নিজেকে যদি আউট সোর্সিং এর সাথে যুক্ত রাখে, তবে নিজেও সমৃদ্ধ হবে এবং দেশের অর্থনৈতিক চাকাও কিছুটা হলেও সচল হবে।
ভোলার উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে জেলা প্রশাসক বলেন, মুজিব শতবর্শে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন চর দৌলতখানের মদনপুর এলাকায় বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং চরফ্যাশনের কুকরী-মুকরীতেও বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ইলিশা ঘাটকে নদী বন্দর করার জন্য নৌ-পরিবহন মন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়ের সাথে এ ব্যাপারে যোগাযোগের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এছাড়া ভোলার ইলিশা থেকে চরফ্যাশনের দক্ষিণ আইচা পর্যন্ত রাস্তা প্রসস্ত করণের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থাও উন্নত করা হচ্ছে।
তৌফিক-ই-লাহী আরো বলেন, ভোলাকে নদী ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষার জন্য সিসি ব্লক স্থাপনের মাধ্যমে ভাঙ্গন প্রতিরোধ করা হয়েছে। নদী ভাঙ্গনের হাত থেকে একটি বড় বরাদ্ধ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, সেটা যদি পাওয়া যায়, তা হলে ভোলাকে অনেকাংশে স্থায়ীভাবে ভাঙ্গন থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে।
ভোলায় রয়েছে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা। পর্যটন নিয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। ইতিমধ্যে চর কুকরী কুমকী, তারুয়া দ্বীপ, মনপুরা, চরফ্যাশন, ভোলা সদরসহ বিভিন্ন স্পটগুলোকে নিয়ে আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে। সেগুলো বাস্তবায়নে কাজ করবো।
ব-দ্বীপ ফোরামের আয়োজনে “ভোলার কাঙ্খিত উন্নয়ন ও নাগরিক সমাজের ভাবনা” শীর্ষক গোল টেবিল বৈঠকে বিশেষ অথিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে বক্তব্য রাখেন পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, সকল উন্নতির আগে আমাদের মানষিক উন্নতি প্রয়োজন। ভোলার দুটি প্রধান সমস্যা। একটি হচ্ছে জমি-জমা বিরোধ এবং অপরটি হচ্ছে নারী নির্যাতন।
জমি-জমা বিরোধের তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, ভোলা ১৭ হাজার জমি-জমা বিরোধ নিয়ে মামলা রয়েছে। এ মামলার কারণে ৩৪ হাজার পরিবার নানান সমস্যার সম্মুখিন। এ থেকে আমাদের উত্তোরণ হতে হবে, তবেই কিছুটা হলেও আমাদের মামলার সংখ্যা কমে যাবে।
সাইফুল ইসলাম বলেন, ভোলার অপর সমস্যা হচ্ছে নারী নির্যাতন। এ সংক্রান্ত মামলাও অনেক। যে সমস্ত বিরোধ নিয়ে মামলা হচ্ছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ধর্ষণ, যৌতুক এবং শিশু নির্যাতন। ভোলার ৩০ শতাংশ মামলাই এ সংক্রান্ত। আগামী এক বছরে এ পরিসংখ্যান আরো কমিয়ে আনার চেষ্টা করবো।
তিনি বলেন, ভোলায় মাদকের অবস্থান সারাদেশের মতই। চতুর্দিকে নদী বেষ্টিত হলেও ভোলায় কোনযাংশে মাদক থেকে মুক্ত হচ্ছে না। ভোলাকে মাদক মুক্ত করতে হলে এর প্রবেশ পথ রুদ্ধ করতে হবে। এরপরে মাদকের সাথে যারা জড়িত তাদেরকেও সনাক্তের মাধ্যমে আইনের আওতায় আনলেই তবেই ভোলাকে মাদকের কড়াল গ্রাস থেকে মুক্ত করা সম্ভব হবে।
পুলিশ সুপার বলেন, সম্প্রতি ভোলায় কিশোর গ্যাং এর উপদ্রব বৃদ্ধির খবর পাওয়া যাচ্ছে। এ কিশোর গ্যাং বন্ধের জন্য বাবা-মা সহ পরিবারের সকলকে সচেতন হতে হবে। কেননা তার সন্তান কোথায় যায়, কি করে তা যদি তারা না জানেন তা হলে এটা রোধ করা সম্ভব নয়। তাই কিশোর গ্যাং রোধের ব্যাপারে পরিবারের সকল অভিভাবকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। এছাড়া আমাদের চারপাশের পরিবেশটা এমন ভাবে ডিজাইন করতে হবে, যাতে করে সমাজে অপরাধ প্রবনতা  কমে যায়।

তিনি আরো বলেন, ভোলার ইলিশা থেকে চরফ্যাশন পর্যন্ত হাইওয়ে রোড প্রসস্ত করণ করা হচ্ছে। এ প্রসস্ত করণের মাধ্যমে এ রুটে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যেতে পারে। এ জন্য রাস্তার গুরুত্বপূর্ণ মোড় ও বিভিন্ন স্থানে লাইটিং এবং সিসি ক্যামেরা স্থাপনের পরিকল্পনার কথাও জানান তিনি। এটা যদি স্থাপন করা যায় তা হলে কিছুটা হলেও অপরাধ প্রবণতা কমে যাবে। অন্যদিকে গুজব প্রতিরোধে সাইবার পেট্রোলিং কার্যক্রমে তরুণ সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। এছাড়া এ কার্যক্রমে সমাজের পরিচিতমুখ এমন লোককেও সম্পৃক্ত করা হবে।
দৈনিক আজকের ভোলার সম্পাদক মুহাম্মদ শওকাত হোসেন এর সভাপতি এবং চট্টগ্রাম বন গবেষণা কর্মকর্তা এম জহিরুল ইসলামের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন ব-দ্বীপ ফোরামের প্রধান সমন্বয়কারী মীর মোশারেফ হোসেন অমি। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মামুন আল ফারুক, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ ও প্রশাসন) আবুল কালাম আজাদ, মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক এম এ তাহের, প্রফেসর রুহুল আমিন জাহাঙ্গীর, জেলা শিক্ষা অফিসের গবেষণা কর্মকর্তা মুহাম্মদ নুরে আলম সিদ্দিকী প্রমূখ।
ভোলার বিভিন্ন সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে উন্মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন মানবাধিকারকর্মী মোবাশ্বির উল্লাহ চৌধুরী, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জোনাল ম্যানেজার মোঃ আলতাফ হোসেন, ভোলা সড়ক ও জনপদ বিভাগের সাবস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার মোঃ রাসেল, ওজোপাডিকো’র নির্বাহী প্রকৌশলী মামুনুর রশিদ, জেলা বিজেপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আমিরুল ইসলাম রতন, সাধারণ সম্পাদক মোতাছিম বিল্লাহ, থানা বিএনপির সদস্য সচিব আসিফ আলতাফ, উপজেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোঃ মহিউদ্দিন, জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কাদের সেলিম, শিক্ষক ও সাংবাদিক মনিরুল ইসলাম, মানবাধিকার কর্মী মোঃ হোসেন, সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানীর ঠিকাদার মোঃ বেল্লালসহ অনুষ্ঠানে সরকারী, বেসরকারী অফিসের কর্মকর্তা, বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, শিক্ষক, সাংবাদিক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিগণ উপস্থিত ছিলেন।
ব-দ্বীপ ফোরাম যে সমস্ত দাবীগুলো তুলে ধরেন সেগুলো হচ্ছে- ভোলায় উত্তোলিত গ্যাস অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গৃহস্থালী কাজের জন্য সংযোগ দেওয়ার ব্যবস্থা করা। যানবাহনের জন্য সিএনজি গ্যাসের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা। সকল উপজেলায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ নিশ্চিত করার পরে জাতীয় গ্রীডে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরী ও ইপিজেড প্রতিষ্ঠায় তড়িৎ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। স্যাগ ও বিদ্যুৎ ভিত্তিক সকল প্রতিষ্ঠানে জনশক্তি হিসেবে ভোলাবাসীকে অগ্রাধিকার দেয়া। এছাড়া জাতীয় অর্থনীতিতে ভোলার অবদানকে বিবেচনায় নিয়ে ভোলার জন্য ১০ দফা তুলে ধরেছেন। সেগুলো হচ্ছে- ভোলাতে ১টি সরকারী মেডিকেল কলেজ স্থাপন, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত ভোলা-বরিশাল সেতু বাস্তবায়ন, দেশের প্রতিটি জেলায় একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের আওতায় ভোলায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, খাদ্যসশ্য এবং মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত হিমাগার তৈরী, ফুড প্রোসেসিং এবং মৎস্য প্রোসেসিং ইন্ড্রাষ্ট্রি গড়ে তোলা, ভোলা-লক্ষ্মীপুর ফেরি রুটে ড্রেজিং করে রুটটিকে কার্যকর করে ভোলার সাথে ২১টি জেলার যোগাযোগ বৃদ্ধি করা এবং ভবিষ্যতে এ রুটে ব্রীজ করা যায় কি না তা ভাবা, ভোলার নারিকেল-সুপারির ছোবড়া দিয়ে এক্সপোর্ট কোয়ালিটির ইন্ডাষ্ট্রি করা, ভোলার অভ্যান্তরীণ সড়কগুলোর উন্নয়ন এবং ভোলা-চরফ্যাশন আঞ্চলিক মহাসড়কটিকে মহাসড়কে ঘোষণা করে ডাবল লাইনে উন্নতি করা, দ্বীপজেলা হলেও এখানে কোন পোর্ট নেই। ইলিশা ঘাটে একটি বন্দর স্থাপন এবং ভোলার কর্মসংস্থানের জন্য আরো কি কি পদক্ষেপ করা যায় সে বিষয়ে সমীক্ষা চালানো বা ভোলা দ্বীপ উন্নয়ন বোর্ড গঠন করা।