Shadow

এগারো ধরনের বৈষম্যমূলক প্রাইমারি শিক্ষা অসাংবিধানিক ও জাতির জন্য বিপজ্জনক

ড. মইনুল ইসলাম : দেশের কওমী মাদ্রাসা-ভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম সরকারের প্রস্তাবিত শিক্ষা সংস্কার নীতিকে ’নাস্তিক্যবাদী’ আখ্যায়িত করে তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। কথায় কথায় সবকিছুতে নাস্তিকতার ফতোয়াবাজি করা সংগঠনটির অভ্যাসে পরিণত হয়েছে, হয়তো এদের ধারণা হয়েছে যে সরকার তাদের ভয়ে কম্পমান। এই সংগঠনটির যেহেতু জঙ্গিবাদী তান্ডব সৃষ্টির ঐতিহ্য রয়েছে তাই সরকার নিজেদের অবস্থানে অটল থাকার সাহস দেখাতে পারবে কিনা সেটাই এখন পর্যবেক্ষণের বিষয়। আমার মতে, প্রাইমারী শিক্ষার সমপর্যায়ে ’একক মানসম্পন্ন শিক্ষাব্যবস্থা’ চালু করার জন্যে যেহেতু সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে তাই এই ইস্যুতে সরকারের পশ্চাদ্পসরণের কোন সুযোগ নেই। কওমী মাদ্রাসাগুলোর মধ্যযুগীয় কারিক্যুলাম অনুসরণের জবরদস্তিকে তাদের জঙ্গিপনার ভয়ে সরকারের এতদিন মেনে নেয়াটাই তাদের স্পর্ধাকে বাড়িয়ে দিয়েছে মনে করি। এবার বোধ হয় এ-ধরনের ফতোয়াবাজিকে প্রতিরোধ করাটা জাতির ভবিষ্যতের জন্যে ’ফরজ’ হয়ে গেছে।
গত ১১ মার্চ ২০১৬ তারিখ টেলিভিশনে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর একটা উক্তি আমাকে বেশ নাড়া দিয়েছিল। বর্তমান সরকার মাদ্রাসা শিক্ষার বিরোধী নয় উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, বর্তমান সরকার আরো ২৫টি মাদ্রাসা স্থাপন করেছে। বর্তমানে দেশের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারের প্রতিপক্ষ বিএনপি’র দিকেই, এটা তিনি জানেন। সন্দেহ করার কারণ রয়েছে যে দেশের মাদ্রাসাগুলোর বৃহদংশই এখনো একশ্রেণীর পাকিস্তান-প্রেমীদের খপ্পরে রয়ে গেছে এবং মাদ্রাসাগুলোর কিছু শিক্ষক এখনো পাকিস্তান-প্রেম ও উর্দু-প্রীতিতে মজে রয়েছেন। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন সাম্প্রতিক এক সেমিনারে বেশিরভাগ মাদ্রাসাকে যে ‘পাকিস্তানী ছিটমহল’ অভিহিত করেছেন সেটাকে উড়িয়ে দেওয়া যাবে কি? এটা কি অস্বীকার করা যাবে যে রাষ্ট্রের ধর্মনিরপে তার নীতি এখনো মাদ্রাসার শিক্ষক ও ছাত্রদের একাংশের কাছে ‘কুফরী মতবাদ’? (মুক্তিযুদ্ধের সময় যে নেজামে ইসলাম দলটি পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করেছিল ঐ দলটির উত্তরাধিকারীরাই কিন্তু এখনকার ইসলামী ঐক্যজোটের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন দলে অবস্থান নিয়েছে, যে দলগুলোর প্রধান ঘাঁটি কওমী মাদ্রাসাগুলো।) বিশেষত, কওমী মাদ্রাসাগুলো যেহেতু দেওবন্দী-ওয়াহাবী ভাবধারার মৌলবাদী ইসলামের অনুসারীদের দ্বারা পরিচালিত হয় তাই ওগুলোর ছাত্র-শিক্ষকদের বেশিরভাগই রাষ্ট্রের ধর্মনিরপে তার নীতির ঘোর বিরোধী। ২০১৩-১৪ সালের রাজনৈতিক সংকটের সময় বিএনপি-নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট কওমী মাদ্রাসা-কেন্দ্রিক ‘হেফাজতে ইসলাম’কে ব্যবহার করে বর্তমান মহাজোট সরকারের পূর্বসূরি সরকারকে প্রায় উল্টে দিতে সমর্থ হয়েছিল। এরপর থেকে সরকার মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদেরকে বিএনপি-জামায়াত-হেফাজতের খপ্পর থেকে মুক্ত করার ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। উপরে উল্লিখিত শিক্ষামন্ত্রীর সাম্প্রতিক এই বক্তব্যও এই উদ্দেশ্যেই হয়তো নিবেদিত। একজন রাজনীতিবিদের পক্ষে এহেন উচ্চারণ খুবই যৌক্তিক। কিন্তু, শিক্ষামন্ত্রী নাহিদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, সংবিধানের ১৭ ধারায় বর্ণিত আপনার দায়িত্বটি অনুগ্রহ করে স্মরণে রাখবেন। দেশের সংবিধানের ১৭ (ক) ধারায় রাষ্ট্র নাগরিকদের কাছে অঙ্গীকার করছে, ‘রাষ্ট্র সকল শিশুর জন্য একটি একক মানসম্পন্ন, গণমুখী, সর্বজনীন, অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা ব্যবস্থা আইনের মাধ্যমে নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত চালু করার লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে’।
উপরে উল্লিখিত অঙ্গীকার মোতাবেক দেশের প্রাথমিক পর্যায়ের মাদ্রাসা শিক্ষাকে ধাপে ধাপে মূল ধারার প্রাথমিক শিক্ষার ‘একক মানসম্পন্ন’ কারিক্যুলামে নিয়ে আসাই সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব। এই সাংবিধানিক অঙ্গীকার বাস্তবায়নের জন্য বঙ্গবন্ধুর সরকার ১৯৭২ সালেই পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক ঘোষণা করার পাশাপাশি দেশের সকল প্রাথমিক স্কুলকে জাতীয়করণ করেছিল। ১৯৭৪ সালে কুদরতে খুদা শিক্ষা কমিশনের যে প্রতিবেদনটি সরকার গ্রহণ করেছিল তাতে ঐ বাধ্যতামূলক, অবৈতনিক ও একক মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বর্ধিত করার প্রস্তাব ছিল। জাতির দুর্ভাগ্য, কুদরতে খুদা কমিশনের রিপোর্ট সরকার গ্রহণ করেছে মর্মে সরকারী গেজেট প্রকাশিত হওয়ার আগেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছিলেন। ঐ রিপোর্টের সুপারিশগুলো ১৯৭৫-১৯৯৬ এর ২১ বছরে কোন সরকারেরই সুবিবেচনা পায়নি, যদিও জিয়াউর রহমান, এরশাদ ও বেগম খালেদা জিয়ার ১৯৯১-১৯৯৬ মেয়াদের সরকার নিজেদের পছন্দমাফিক একাধিক শিক্ষা কমিশন বা কমিটি গঠন করেছে এবং শিক্ষা নিয়ে এন্তার ‘তোগলকী এক্সপেরিমেন্ট’ চালিয়েছে। এমনকি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদের সরকার কর্তৃক গঠিত ‘শামসুল হক কমিটির’ রিপোর্টেও এই বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছিল। ২০০৯ সালে মতায় ফিরে আসার পর শেখ হাসিনার মহাজোট সরকার কর্তৃক প্রফেসর কবির চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত কমিটির প্রতিবেদনে এই সাংবিধানিক অঙ্গীকারটিকে বাস্তবায়নের সুস্পষ্ট সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, এবং বর্তমানে তা বাস্তবায়নাধীন রয়েছে।
এদেশে ১১ ধরনের প্রাথমিক শিক্ষা চালু রয়েছে বলে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী একবার আফসোস্ করেছিলেন। এই ১১ ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তালিকাটা দেখুন: ১) সরকারী প্রাইমারী স্কুল, ২) এক্সপেরিমেন্টাল প্রাইমারী স্কুল, ৩) রেজিস্টার্ড বেসরকারী প্রাইমারী স্কুল, ৪) নন-রেজিস্টার্ড বেসরকারী প্রাইমারী স্কুল, ৫) প্রাইমারী ট্রেনিং ইনস্টিটিউট-সংযুক্ত প্রাইমারী স্কুল, ৬) কমিউনিটি স্কুল, ৭) সেটেলাইট স্কুল, ৮) হাই স্কুলের সাথে সংযুক্ত প্রাইমারী স্কুল, ৯) এনজিও পরিচালিত স্কুল, ১০) কিন্ডারগার্টেন ও ১১) এবতেদায়ী মাদ্রাসা। শিক্ষাজীবনের শুরুতেই শিশুকে এত ধরনের বৈষম্যমূলক শিক্ষা ব্যবস্থার জালে আটকে ফেলার এহেন নৈরাজ্যকর ব্যবস্থা বিশ্বের আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। পিতামাতার বিত্তের নিক্তিতে ওজন করে নির্ধারিত হয়ে যাচ্ছে কে কিন্ডারগার্টেনে যাবে, কে সরকারী বা বেসরকারী প্রাইমারী স্কুলে সুযোগ পাবে, কার এনজিও স্কুলে ঠাঁই হবে, আর কাকে এবতেদায়ী মাদ্রাসায় পাঠিয়ে বাবা-মা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে যে ‘লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে’ ভাতটা তো অন্ততঃ জুটলো! এভাবে সারা জীবনের জন্য ঐ শিশুকে বৈষম্যের অসহায় শিকারে পরিণত করে ফেলা তার মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। বড় হয়ে সে বাবা-মাকে অভিশাপ দেবে কিংবা পরিবারের দারিদ্র্যকে দোষ দেবে তাকে ভুল স্কুলে বা মাদ্রাসায় পাঠানোর জন্য, কিন্তু তখন আর ভুল সংশোধনের কোন উপায় থাকবে না। এর অপর পিঠে দেশে ইংরেজী মাধ্যম কিন্ডার গার্টেনের সংখ্যাবৃদ্ধিকেও নাটকীয় বলা চলে। মধ্যবিত্ত, উচ্চ-মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত পিতামাতারা তাঁদের সন্তানদের জন্য এখন আর বাংলা মাধ্যম প্রাইমারী স্কুলগুলোকে উপযুক্ত মানসম্পন্ন মনে করছেন না, কিন্ডার গার্টেনে পড়ানোটাই নিয়মে পরিণত হয়ে গেছে গত চার দশকে। এগারো ধরনের প্রাথমিক শিক্ষা চালু থাকতে দেওয়া কি অসাংবিধানিক নয়? সরকার যদি মনে করে থাকে কিন্ডার গার্টেনের কারিক্যুলাম আধুনিক ও যুগোপযোগী তাহলে সংবিধানের ১৭ ধারায় প্রদত্ত অঙ্গীকার অনুযায়ী ওটাকেই প্রাথমিক শিক্ষার একক কারিক্যুলাম করা হবে না কেন?
বর্তমান সরকারের কর্তাব্যক্তিরা এই সরকারকে ‘শিক্ষাবান্ধব সরকার’ অভিহিত করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলে সদাব্যস্ত, কিন্তু আমরা কি জানি যে শিক্ষা খাতে সরকারী ব্যয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্নে পৌঁছে গেছে? শিক্ষা খাতে এবারের বাজেট বরাদ্দ বাজেটের ১১ শতাংশ, যা জিডিপি’র শতাংশ হিসেবে মাত্র ১.৭৭ শতাংশ। ইউনেসকো বলছে, জিডিপি’র ছয় শতাংশ শিক্ষাখাতে ব্যয় করা উচিত, বাংলাদেশও ঐ অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষরকারী দেশ। শিক্ষামন্ত্রী নাহিদ প্রতিবারই বাজেটের সময় আসলে প্রধানমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রীর কাছে আহ্বান জানান, শিক্ষাখাতের বরাদ্দ অন্ততঃ জিডিপি’র তিন শতাংশে বৃদ্ধি করুন। অথচ, এবার সরকার এই অনুপাতকে টেনে দুই শতাংশের নিচে নিয়ে এসেছে! মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রীসভার সদস্যদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, একটি যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশের সংকটাপন্ন অবস্থা সত্ত্বেও ১৯৭২-৭৩ সালের বাজেটে বঙ্গবন্ধু সরকার শিক্ষা ও ক্রীড়া খাতে বাজেটের সর্বোচ্চ ২১.১৬ শতাংশ বরাদ্দ করেছিল, আর প্রতিরক্ষা খাতে ঐ বছর বরাদ্দ ছিল বাজেটের ৯.৪৮ শতাংশ। ১৯৭৫ সালের হত্যাযজ্ঞের পর ১৯৭৬-৭৭ সালের বাজেটে প্রতিরক্ষা খাতের ব্যয় বরাদ্দ নাটকীয়ভাবে বেড়ে ২২.২৭ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল, শিক্ষাখাতের বরাদ্দকে টেনে নামানো হয়েছিল ১৩.৩৫ শতাংশে। ১৯৮৩-৮৪ সালের বাজেটে প্রতিরক্ষা খাতের বরাদ্দ আরো বেড়ে ২২.৭০ শতাংশ হয়েছিল, আর শিক্ষা ও ক্রীড়া খাত ঐ বছর পেয়েছিল মাত্র ৮.৬৯ শতাংশ। এবারের বাজেটে আবার শিক্ষাখাতের বরাদ্দ বাজেটের ১১ শতাংশে চলে এসেছে! এটা কি কাকতালীয় যে ১৯৮৩ সালে এবং ২০১৬ সালে একই ব্যক্তি বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী?
২০১৫ সালের এপ্রিলে মাননীয় অর্থমন্ত্রী একটি সরল স্বীকারোক্তি করেছিলেন, ‘আলীয়া মাদ্রাসাগুলোর কারিক্যুলাম এখন যথেষ্ট উন্নত হলেও কওমী মাদ্রাসার অর্থায়ন যেহেতু সরকার করে না তাই ওগুলোর কারিক্যুলামের ব্যাপারে কিছু করা যাচ্ছে না’। তার মানে কি অপ্রতুল বাজেটবরাদ্দ একক মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষার অর্থায়নের পথে প্রধান বাধা? অর্থমন্ত্রীর স্বীকারোক্তিতে বর্ণিত সরকারের এই অপারগতা শিক্ষার ব্যাপারে অত্যন্ত দুঃখজনক ও বিপজ্জনক একটি বাস্তবতাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল। ঐ মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে রচিত এক কলামে আমি দেখিয়েছিলাম, বঙ্গবন্ধুর সরকারের সময় যে সমস্যাটা গৌণ ছিল তা গত ৪১ বছরে একটা মহাসংকটে পরিণত হয়েছে–এই সংকটটি মাদ্রাসার নাটকীয় বিস্তার এবং বিশেষত হাজার হাজার ‘স্বাধীন কওমী মাদ্রাসার’ নাটকীয় বিস্তার। বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোস্পানির শাসনামলে ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে কোলকাতা আলীয়া মাদ্রাসার মাধ্যমে যে মাদ্রাসা শিক্ষার ধারা প্রচলিত হয়েছিল, সেটাই নানাবিধ পরিবর্তন-পরিবর্ধন-সংস্কারের মাধ্যমে এদেশের আলীয়া মাদ্রাসাগুলোতে অনুসৃত হচ্ছে। দেওবন্দ ঘরানার মাদ্রাসাগুলোতে বাগদাদের আব্বাসীয় শাসনামলের ‘নিজামীয়া কারিক্যুলাম’ অনুসৃত হচ্ছিল, যা এখনকার কওমী মাদ্রাসাগুলোতেও সামান্য সংস্কার করে চালু রাখা হয়েছে। সাধারণ জনগণের মধ্যে কওমী মাদ্রাসাগুলোর পরিচয় ‘ওহাবী মাদ্রাসা’ হিসাবে। বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান এবং এরশাদ মাদ্রাসা শিক্ষাকে রাজনৈতিক প্রয়োজনে বিশেষ পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করায় গত ৪১ বছরে এদেশে হাজার হাজার মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আবার, সৌদী আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত ও কাতারের মত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর তেল সম্পদের খুদ-কুঁড়া হিসেবে মাদ্রাসাগুলোতে যে বিদেশী খয়রাত প্রবাহিত হচ্ছে ঐ খয়রাতের বড় অংশটাই কওমী মাদ্রাসাগুলো আকৃষ্ট করতে সমর্থ হয়েছে। মাদ্রাসাগুলোতে যেহেতু একইসাথে আবাসিক সুবিধা এবং আহারের ব্যবস্থা থাকে তাই নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানদের জন্য এগুলোর আকর্ষণ ক্রমবর্ধমান। সরকার বলছে, কওমী মাদ্রাসায় প্রায় ষোল লাখ ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে। প্রকৃত ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা আরো অনেক বেশি হবে বলে সন্দেহ করার কারণ রয়েছে। মাধ্যমিক শিক্ষায়ও চারটি ধারার সমান্তরাল অবস্থান–ইংরেজি মাধ্যমের নানান কিসিমের মহার্ঘ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মূল ধারার বাংলা মাধ্যম সরকারী স্কুল, বাংলা মাধ্যম বেসরকারী স্কুল এবং কয়েক ধরনের মাদ্রাসা। কুদরতে খুদা কমিশন ধাপে ধাপে ক্যাডেট কলেজগুলোকে মূলধারার মাধ্যমিক শিক্ষার সাথে একীভূত করার সুপারিশ করেছিল, অথচ এখন উল্টো সারা দেশে ও লেভেল/এ লেভেল চালু হচ্ছে যত্রতত্র। এই বিভাজিত ও বৈষম্যমূলক শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে আমরা এক দেশের মধ্যে চারটি পৃথক জনগোষ্ঠী সৃষ্টি করে চলেছি! এ-ব্যাপারে আমাদের শাসক মহলের কোন অপরাধবোধের বালাই নেই, অথচ এটা নিঃসন্দেহে জাতির জন্য আত্মঘাতী হতে বাধ্য।
এ-পর্যায়ে সাধারণ পাঠকদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক দাবিদার নির্বিশেষে বিশ্বের প্রায় সকল দেশেই প্রাথমিক শিক্ষা এবং মাধ্যমিক শিক্ষা একক মানসম্পন্ন ও বাধ্যতামূলক করার ব্যাপারে সাংবিধানিক বিধি-ব্যবস্থা রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও সিঙ্গাপুরে বসবাস করার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, কোন্ এলাকার ছেলেমেয়ে কোন্ স্কুলে পড়বে তা নির্দিষ্ট করা থাকে–পিতামাতার ইচ্ছা কিংবা আর্থিক সঙ্গতির ওপর ব্যাপারটা নির্ভর করে না। যুক্তরাষ্ট্রে এই এলাকাগুলোকে ‘প্রিসিঙ্কট’ বলা হয়। পিতামাতা যতই ধনাঢ্য হোক্ না কেন তাঁদের সন্তানরা কোন্ প্রিসিঙ্কটের কোন্ স্কুলে পড়বে সেটা নগরীর স্কুল কর্তৃপক্ষই নির্ধারণ করে দেয়, বাবা-মাকে এ ব্যাপারে নিজেদের ইচ্ছা খাটানোর কোন সুযোগ দেওয়া হয় না। এ ব্যাপারে সন্তানের মানবাধিকারের রক্ষাকর্তা পিতামাতা নয়, রাষ্ট্র। কোন সভ্য দেশেই প্রাথমিক শিক্ষার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারে পিতামাতাকে একক অধিকার দেওয়া হয় না। কারণ, পুত্রকন্যা পিতামাতার সম্পত্তি নয়। শিশু নিজেও এ-ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারার কথা নয়। যে মৌলিক দর্শন এক্ষেত্রে বিবেচ্য তাহলো, বাবা-মায়ের সিদ্ধান্তে কিংবা তাঁদের আর্থিক সংগতির অভাবে কোন শিশু যদি তার শৈশবকালে যুগোপযোগিতাহীন বা তার অপছন্দের কোন শিক্ষাগ্রহণে বাধ্য হয় তাহলে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর ভুল শোধরানোর সুযোগ সে পাবে না। এই বিবেচনা থেকেই অপ্রাপ্তবয়স্ক ভবিষ্যৎ নাগরিকদের মানবাধিকার রক্ষার তাগিদে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাকে একক মানসম্পন্ন করার জন্য জাতিসংঘের ১৯৪৮ সালের ‘মানবাধিকার ঘোষণায়’ অঙ্গীকার লিপিবদ্ধ হয়েছে, এবং জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন ইউনেস্কোর সকল সদস্য এ-বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণে অঙ্গীকারাবদ্ধ, বাংলাদেশও।
২২ মার্চ ২০১৬ তারিখে দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত আমার কলামে আমি উল্লেখ করেছিলাম, বর্তমানে বাস্তবায়নাধীন বাংলাদেশের শিক্ষা নীতিতে কওমী মাদ্রাসার কারিক্যুলামকে যুগোপযোগী করার জন্য চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা শফীর নেতৃত্বে বেফাক নামের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল, কিন্তু গত ছয় বছরে ঐ কমিটির একটি সভাও অনুষ্ঠিত হয়নি তাঁর অনাগ্রহের কারণে। সরকারও রাজনৈতিক স্পর্শকাতরতার বিবেচনায় হেফাজতে ইসলামের এই মহাপ্রভাবশালী নেতাকে চটাতে চাইছে না। অতএব, কওমী মাদ্রাসার কারিক্যুলাম সংস্কারের কাজটি এক কদমও এগোয়নি। সেজন্যেই কওমী মাদ্রাসাগুলোর অসাংবিধানিক ‘স্বাধীনতা’ অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু, এর ফলে লক্ষ লক্ষ শিশুর মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন যে সরকার রাজনৈতিক কারণে হজম করে যাচ্ছে তা তো গ্রহণযোগ্য নয়। জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে পঙ্গু করার এবং পশ্চাৎপদতার দুষ্টচক্রে বন্দী করে রাখার অধিকার কোন ধর্মীয় নেতাকে বা তাঁর জঙ্গিবাদী সাগরেদদেরকে দেওয়া যেতে পারে না। তাঁরা নিজেরা সুযোগ পেয়েও কওমী মাদ্রাসার কারিক্যুলাম পরিবর্তনে অংশগ্রহণ করলেন না, এখন আবার সরকারের প্রস্তাবিত সংস্কারকেও ‘নাস্তিক্যবাদী’ বলে হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন, এটা কি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না? (সংগৃহীত)
লেখক : অর্থনীতিবিদ; প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *