Shadow

জেলেদের জীবিকায়নের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা প্রয়োজন

করোনায় যেমন আছে জেলেরা :
করোনা মোকাবেলায় অনেক শ্রেণি-পেশার মানুষকে নিয়ে সরকারী ও বেসরকারীভাবে পরিকল্পনার কথা বলা হলেও জেলেদের অবস্থা ভিন্ন। জেলেদের সাথে আলোচনাকালে জানা যায় জাটকা অবরোধকালীন সময় ৪ বার প্রতিমাসে ৪০ কেজি চাল করে পাওয়ার কথা থাকলেও ইতিমধ্যে জেলেদের কাছে চাল পৌঁছেছে মাত্র ১ বার, করোনার কারনে চাল বিতরণ বন্ধ জেলেরা ভাবছেন তারা আদৌ চাল পাবেন কি-না । যদিও বরাদ্দ অনুসারে সেই চাল মাত্র ৬০% নিবন্ধিত জেলে পেয়ে থাকেন, উদাহরণ স্বরুপ ভোলা জেলার কথা বলা যেতে পারে, ভোলা জেলায় মোট নিবন্ধিত জেলে সংখ্যা ১ লক্ষ ৩১ হাজার কিন্তু চালের বরাদ্দ আছে মাত্র ৭০ হাজার জেলের জন্য, এছাড়াও প্রায় ৫০ হাজার জেলে আছে যারা বিভিন্ন কারনে নিবন্ধিত হতে পারেনি, তারা সরকারী কোন সেবাই পাচ্ছেনা । এছাড়া কিছু নির্ধারিত এলাকা অভয়াশ্রম ঘোষণা করার ফলে সেখানের জেলেরা নদীতে মাছ ধরতে নামতে পারছেনা ফলে তারা মানবেতর জীবন যাপন করছেন। ভোলার জেলে নেতা এরশাদ মাঝি বলেন ‘‘ মেঘনা নদী অভয়াশ্রম ঘোষণা করে মাছ ধরা বন্ধ রাখলেও কোন প্রকার সহযোগিতা জেলেদের করা হয়নি বা কোন বরাদ্দ নেই’’। এছাড়াও যারা গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যাচ্ছেন তারা বরফকলগুলো বন্ধ থাকার কারনে পড়ছেন বিপাকে । করোনার কারনে মাছ ধরা নিষিদ্ধকালীন সময় অবরোধ শীথিল হলেও সেকল জেলে নদীতে ও সাগরে মাছ ধরতে যাচ্ছেন, তারা পরিবহনের অভাবে মাছ বিক্রি করতে পারছেন না বা সংরক্ষণ করতে পারছেন না । তাই এই জেলেদের বিষয় গুরুত্ব দেয়া খুবই জরুরী জরুরী ।

খাদ্য নিরাপত্তাঃ
প্রতি বছর জেলে পাড়াগুলো ৩-৪ মাসের জন্য খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। অমৌসুমে মাছ ধরা বন্ধ রাখার কারণে এই খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এপ্রিল-জুলাই মাসে খাদ্যের অভাব প্রকট আকার ধারণ করে। শুধু মাত্র অল্প কিছু জেলে যাদের কৃষি জমি আছে কেবল তারাই বছর জুড়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে।
আয়ে অনিশ্চিয়তাঃ
সকল জেলেরাই আয়ের ব্যাপারে তাদের ভাগ্যের উপরে নির্ভর করে। আজকাল এমন কোন নিশ্চয়তা নেই যে, তারা প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে মাছ ধরতে পারবে যা তাদের জীবিকার দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাবে। যেহেতু তাদের প্রায় সকলেরই ঋণ রয়েছে তাই আগামী দিনের পারিবারিক প্রয়োজন মেটানোর মত কোন সঞ্চয় তাদের হাতে নেই। মাছ সংরক্ষণ প্রচারাভিযান পরিচালনার ফলে এই অনিশ্চয়তা কয়েক গুন বৃদ্ধি পেয়েছে। মাছ ধরার ভরা মৌসুমে (বর্ষাকালে) অনেক জেলেই তাদের প্রতিদিনের অভিযানে পর্যাপ্ত পরিমাণ মাছ ধরতে ব্যর্থ হচ্ছে। অনেকেই অভিযোগ করেন যে, ওই সময়ে তাদের প্রচুর জ্বালানী, আনুষঙ্গিক অন্যান্য স¤পদ এবং শ্রমের অপচয় হয়। এই অবস্থা উপক’লীয় অঞ্চলে বসবাসরত দরিদ্রদের জীবিকায় সু¯পষ্ট প্রভাব বিস্তার করে।
বিভিন্ন মৌসুমে জেলেদের জীবিকার কৌশল
সকল জেলেদের জীবিকার কৌশল কম বেশি একই ধরণের। অধিকাংশই মাছ ধরা ছাড়া অন্য কোন ধরণের আয় বর্ধক কাজ জানে না। অতয়েব, বছর জুড়েই তারা নদীতে মাছ ধরার চেষ্টা চালায়। ভরা মৌসুমে তারা কাছাকাছি নদী এবং মেঘনার গভীরে ইলিশ ধরে। এছড়াও তারা বছর ব্যাপি তারা অন্যান্য প্রজাতির মাছ যেমন- চাওয়া, পোয়া, বেলে, আইড়, বোয়াল, পাঙ্গাস, রিঠা, তাপসী, পুঁটি, বাঁচা, হোলা, চিংড়ি ইত্যাদিও ধরে থাকে। যখন মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকে তখন অধিকাংশ জেলে পরিবার কর্মহীন থাকে এবং দাদনদারের কাছ থেকে ঋণ এবং দাদন নিয়ে সংসার চালায়। এই সময় ১০% জেলেরা দিন মজুরী কাজ কিংবা মাছের আড়ৎদারের কাজ করে।
ঝুঁকি এবং দুর্যোগ পরিস্থিতি/উপলব্ধি
অন্যান্য জীবিকার মতই মাছ ধরা পেশা ভোলা জেলায় নানাবিধ ঝুঁকি দ্বারা পরিবেষ্ট। যেকোন পেশার ক্ষেত্রেই যদি ঝুকি মোকাবেলায় যথাযথ কৌশল গ্রহণ করা না হয় তাহলে তা সেই জীবিকার স্থায়ীত্বকে অরক্ষিত করে দিতে পারে। পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেবার সক্ষমতা কিংবা পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নেবার অক্ষমতার কারণে জেলে সমাজের পক্ষে মাছ ধরার ক্ষেত্রে বিরাজমান ঝুঁকি সমূহ চিহ্নিত করা কঠিন। যদিও সঠিক স্থানে যথাযথ নীতিমালা প্রনয়ণ এবং এর সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে এসব ঝুঁকি বহুলাংশে হ্রাস এবং সহনীয় করে তোলা যায়। অধিক আয়ের প্রত্যাশার কারণে উপক’লীয় এলাকায় মাছ ধরা পেশা সব সময়েই মানুষকে আকৃষ্ট করে আসছে। কিন্তু বাস্তবতা হল সমপর্যায়ের অন্যান্য অনেক খাত কিংবা উপখাতের তুলনায় বেশি আয় করলেও জেলেরা সব সময়ে দরিদ্রই থেকে যায়।
জেলেদের ঋন সুবিধা : কৃষকদের কৃষি ঋন সুবিধা থাকলেও ব্যাংক লোন পাবার সুযোগ না থাকায় জেলেদের অপ্রাতিষ্ঠানিক লোনের (দাদন, উচ্চ সুদে ঋণ) উপরে নির্ভর করতে হয়। জেলে সমাজে ক্ষুদ্র ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চলমান থাকলেও এনজিওদের প্রদত্ত ঋণের সর্বোচ্চ সীমা জেলেদের চাহিদার তুলনায় অনেক কম। এর ফলে বর্তমানে প্রচলিত ক্ষুদ্র ঋণ কাঠামো উপক’লীয় এলাকার জন্য খুব একটা কার্যকর নয়। যার ফলে জেলেরা স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য কিন্তু উচ্চ হারে সুদ সম্বলিত ঋণের উপর নির্ভরশীল হতে বাধ্য হচ্ছে।

নীতিমালা বাস্তবায়নে সুপারিশমালা
* উপকূলীয় এলাকার মানুষের প্রয়োজনকে গুরুত্ব দিতে পারে এমন একটি ব্যাংক/আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য সুপারিশ করা হল। উপকূলীয় জেলে সম্প্রদায়ের জন্য চলমান ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবস্থা পর্যালোচনা এবং পূনঃনকশা করা প্রয়োজন যেখানে সঞ্চয়ের উপরে বেশি গুরুত্ব থাকবে। সুপারিশ করা যাচ্ছে যে, এনজিওগুলো স্থানীয় অবস্থা (যেমন-ঝুকি, মৌসুম, প্রয়োজনীয় লোনের পরিমাণ, আয়ের প্রবাহ ইত্যাদি) বিবেচনা করে উৎপাদনশীল খাতে সহজ শর্তে ঋণ প্রদান প্রয়োজন। ।
* মাছ ধরার চাপ কমানোর জন্য এই ক্ষেত্রে যাতে অনেক বেশি জেলের আগমণ প্রতিরোধ করতে হবে। দীর্ঘ সময়ের জন্য বিশেষ পরিকল্পনার মাধ্যমে জেলেদের জন্য কার্যকর বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা করতে হবে। বিশেষ করে যুবক শ্রেণিকে আয় বর্ধক পেশায় স¤পৃক্ত করতে হবে। তরুণ জেলেদের জন্য আয়বর্ধক কাজের ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যবস্থা, অনুপ্রেরণা, এবং সহায়তা দিতে হবে এবং সরকারী এবং বেসরকারীভাবে জেলে সম্প্রদায়ের উপরে বিশদ গবেষণা পরিচালনা করা প্রয়োজন।
* উপকূলীয় এলাকার জন্য বিশদভাবে সরকার কিংবা দাতা সংস্থার অর্থায়নে সামাজিক উন্নয়ন/ক্ষমতায়ন এবং নেতৃত্ব বিকাশে প্রকল্প শক্তিশালী করতে হবে। সামাজিক সংগঠনগুলোকে শক্তিশালীকরণ এবং দরিদ্রদের অধিক অন্তর্ভুক্তির জন্য চেষ্টা চালাতে হবে।
*  জিডিপিতে জেলেদের অবদান ধরে রাখতে হলে তাদের ভিজিএফ’র পাশা-পাশি সরকার ঘোষিত বিশেষ প্রনোদনার আওতায় আনতে হবে এবং ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন ।

মো: জহিরুল ইসলাম

সহকারী পরিচালক

জেন্ডার ও এ্যকুয়াকালচার, কোস্ট ট্রাস্ট ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *