Shadow

নাসরিন ট্রাজেডি : আজো কাঁদায় ভোলাবাসীকে

এম. শরীফ হোসাইন, ভোলা ॥ নাসরিন লঞ্চ দুর্ঘটনার ১৪ বছর পূর্ণ হলো আজ। ২০০৩ সালের ৮ জুলাই ঢাকা থেকে লালমোহনগামী এমভি নাসরিন-১ চাঁদপুরের ডাকাতিয়া এলাকায় ডুবে যায়। লঞ্চটিতে ছিল অতিরিক্ত যাত্রী ও মাল বোঝাই করা। পানির তোড়ে তলা ফেটে লঞ্চটি মুহূর্তের মধ্যে ডাকাতিয়া মোহনায় তলিয়ে যায়। ওই দিন ৯ শতাধিক মানুষের সলিল সমাধি ঘটে। ভোলাবাসীর জন্য আজ শোকাবহের দিন।
১৯৭০ এর প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ের পর ভোলাবাসীর জন্য সবচেয়ে বড় ভয়াবহ সংবাদ ছিল নাসরিন লঞ্চ ট্রাজেডির ঘটনা। অনেকে তার প্রিয়জনদের হারিয়েছেন এই দিনে। লঞ্চ দুর্ঘটনার ইতিহাসে এটি সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা। এই ট্রাজেডিতে জীবিত মৃত সব মিলে ৪০০ যাত্রীর সন্ধান মিললেও প্রায় ৯শ’ যাত্রীর প্রাণহানি ঘটে। দুর্ঘটনার দুইদিন পর থেকে ভোলার মেঘনা পরিণত হয় লাশের নদীতে। সেই ভয়ংকর দৃশ্য মনে করে এখনো শিউরে উঠে ভোলার মানুষ। ওই দুর্ঘটনায় লালমোহন, চরফ্যাশন, তজুমদ্দিনসহ দক্ষিণ অঞ্চলের ৯ শতাধিক যাত্রী প্রাণ হারিয়েছে। উপকূলীয় জনজীবনের ভয়াবহ শোকাবহ এই দিনটি আজও মানুষ ভুলতে পারেনি।
নাসরিন ট্রাজেডির পর ধারাবাহিকভাবে ২/৩ বছর এ দিবসটি দক্ষিণ ভোলায় ঘটা করে পালন করা হয়। দিবসটি পালন উপলক্ষে সপ্তাহব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচিও পালিত হয়েছিল। তবে এই ট্রাজেডির ১৪ বছর পেরিয়ে যাওয়ায় স্বজনহারাদের এখন আর কেউ খোঁজ রাখে না। আজ নাসরিন ট্রাজেডি দিবসের কথা কেউ কেউ মনে করলেও দিবসটি পালন উপলক্ষে শোকসভা, মিলাদ মাহফিল, শোক র‌্যালির মতো কোনো কর্মসূচিও দক্ষিণ ভোলায় আজ আর নেই।
বেসরকারি সেবা সংস্থা কোস্ট ট্রাস্টের হিসাব অনুযায়ী নাসরিন দুর্ঘটনায় ১৭০ জন যাত্রী প্রাণে বেঁচে গেলেও ৯ শতাধিক যাত্রী নিহত ও নিখোঁজ হয়। এর মধ্যে চরফ্যাশনের ১৯৮ জন, লালমোহনের ২৬৪ জন এবং তজুমদ্দিনের ১৩ জনকে শনাক্ত করা গেছে। এদের মধ্যে ১১০ জন ছিল নারী। নিহত বা নিখোঁজ যাত্রীদের মধ্যে ছিল ৩৩ জন রিকশা/ভ্যান চালক, দুইজন ফেরিওয়ালা, তিনজন গার্মেন্টস শ্রমিক, ২৪ জন চাকরিজীবী, ৫৪ জন দিনমজুর, ৩৬ জন কৃষক, ১০ জন ড্রাইভার, ৩৬ জন ব্যবসায়ী, ৩৩ জন ছাত্র, ৬৬ জন গৃহিনী, ৯ জন গৃহপরিচারিকা, ৯৬ জন শিশু ও বৃদ্ধা। এই দুর্ঘটনায় ৪০২টি পরিবারের এক বা একাধিক ব্যক্তি মারা যায়। এসব পরিবারের মধ্যে ১২৮টি পরিবারের উপার্জনক্ষম পুরুষ ব্যক্তি মারা যায়।
প্রিয়জনকে হারিয়ে বছরব্যাপী শোকের মাতম করে লালমোহন-তজুমদ্দিন ও চরফ্যাসনসহ দক্ষিণ ভোলার আপামর মানুষ। চাঁদপুর থেকে হতভাগা অগণিত মানুষের লাশ ভেসে গেছে বঙ্গোপসাগরে। মাছের পেটে নিহত মানুষের মাংসের অস্তিত্ব পাওয়া যাওয়ায় ওই বছর ভোলাবাসী নদীর মাছ খাওয়া বন্ধ করে দেয়। কুকুরে খেয়েছে অনেক মৃত দেহ। বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জের চরে শিশুর লাশের কুকুরে খাওয়া ছবি ছাপা হয়েছে দেশের শীর্ষ স্থানীয় সকল পত্র-পত্রিকায়। জাতীয় সংসদে কেবল শোক প্রস্তাব পাশ করেই দায়িত্ব শেষ করেছে সে সময়ের জোট সরকার।
জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী নৌ-পরিবহনমন্ত্রীকে তলব করেছেন। এসময় সবচেয়ে নির্মম আচরণ করেছেন তৎকালীন নৌ পরিবহন মন্ত্রী স্বয়ং। অদ্ভুত সব কথা বার্তা বলে তিনি দেশের মানুষের মনে কষ্ট দিয়েছেন। দুর্ঘটনাস্থলে গিয়েছেন সপ্তাহখানেক পর। টাইটানিক ট্রাজেডির পড়ে পৃথিবীর নৌ-দুর্ঘটনার ইতিহাসে ২য় বৃহত্তম এই লঞ্চ ডুবির ঘটনায় যেখানে কানাডা ও মার্কিন সরকার শোক প্রকাশ করেছে, সেখানে আমাদের তৎকালীন জোট সরকারের উদাসীনতা প্রশ্নবোধক চিহ্নের জন্ম দিয়েছিল।
সূত্রে আরো জানা গেছে, অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ নাসরিন ট্রাজেডির পরপরই বিভিন্ন তারিখে নাসরিন ট্রাজেডিতে নিহত ও নিখোঁজ যাত্রীদের পরিবারকে ক্ষতি পূরণ দিয়েছে। প্রাপ্ত ক্ষতি পূরণের টাকা নিহত ও নিখোঁজ স্বজনদের পরিবারে কিছুটা উপকারে এলেও বর্তমানে এসব পরিবার খুবই অসহায় হয়ে পড়েছে।
কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও উদাসীনতাসহ প্রচলিত আইনের ব্যত্যয় ঘটার কারণে যথাযথ ক্ষতিপূরণ চেয়ে ২০০৪ সালে ঢাকার তৃতীয় জেলা জজ আদালতে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি-পরিবারের পক্ষে ব্লাস্ট একটি মামলা দায়ের করে। মামলায় ১২১ জন ব্যক্তি বাদী হন। বিবাদী করা হয় সরকারি সংশ্লিষ্ট দপ্তর, লঞ্চ মালিক, সারেং এবং সমিতিসহ মোট ২১ জন/প্রতিষ্ঠানকে।
দুর্ঘটনার দীর্ঘ ১২ বছর পর বিগত ২০১৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারী নিম্ন আদালত ওই মামলার রায় ঘোষণা করে ক্ষতিগ্রস্তদের ১৭ কোটি ১১ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশ দেয়। রায়ে ক্ষতিপূরণ বাবদ নিহতদের পরিবারকে ১০ লাখ টাকা করে, নিখোঁজ পরিবারকে ১০ লাখ টাকা করে ও আহতদের এক লাখ টাকা করে প্রদানের নির্দেশ দেয়।
ওই আদেশের বিরুদ্ধে বিআইডব্লিউটিএসহ বিবাদীপক্ষ বিগত ২০১৬ সালের ২৪ অক্টোবর হাইকোর্টে একটি রিভিশন আবেদন করে। ২০১৭ সালের ৫ জুন বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল করিম ও বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চ রুলটি খারিজ করে ব্লাস্ট কর্তৃক দায়েরকৃত বহুল আলোচিত লঞ্চ দুর্ঘটনায় নিহত ও নিখোঁজ হওয়াসংক্রান্ত মামলা নিম্ন আদালতের রায় বহাল রাখে। উচ্চ আদালতের এ নির্দেশের মাধ্যমে নিম্ন আদালতে দায়েরকৃত মামলায় ১৭ কোটি ১১ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদানসংক্রান্ত প্রদত্ত আদেশ কার্যকর করে সব ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির ক্ষতিপূরণ প্রদানে আর কোনো বাধা থাকলো না। লঞ্চ দুর্ঘটনায় মামলা করে ক্ষতিপূরণ আদায়ের রায় এই প্রথম।
এদিকে নাসরিন ট্রাজেডির শোকাবহ দিবসটিকে স্মরণ করার জন্য এক কর্মসূচী হাতে নিয়েছে দ্বীপজেলা ভোলার লালমোহন উপজেলার প্রগতিশীল সাংবাদিক সংগঠন ‘লালমোহন মিডিয়া ক্লাব’। আগামী ১০ জুলাই ২০১৭ সোমবার সকাল ১০ টায় লালমোহন উপজেলা পরিষদ হলরুমে “নিরাপদ নৌপথ চাই, ভুলি নাই ২০০৩ সালের ৮ জুলাই” শীর্ষক স্মরণসভা ও দোয়া মাহফিলের শুভ উদ্বোধন করবেন লালমোহন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বীরমুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ গিয়াস উদ্দিন আহমেদ।
এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন লালমোহন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ শামছুল আরিফ। প্রধান আলোচক হিসেবে উপস্থিত থাকবেন ভোলা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সামস-উল-আলম মিঠু। সভাপতিত্ব ও সঞ্চালনা করবেন লালমোহন মিডিয়া ক্লাবের সভাপতি ও উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সম্পাদক কবি প্রভাষক রিপন শান। স্বাগত বক্তব্য রাখবেন লালমোহন মিডিয়া ক্লাবের সম্পাদক সাংবাদিক ফয়েজ ফ্যাশন।
বিশেষ অতিথি উপস্থিত থাকবেন উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি অধ্যাপক বজলুর রহমান, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ফখরুল আলম হাওলাদার, উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক দিদারুল ইসলাম অরুন, পৌর আওয়ামী লীগ সম্পাদক সফিকুল ইসলাম বাদল, ইউপি চেয়ারম্যান আবুল কাশেম মিয়া, আবুর বাশার সেলিম, মোঃ শাহজাহান মিয়া, লালমোহন বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আলহাজ মোস্তফা মিয়া, লালমোহন পৌরসভার কাউন্সিলর ও উপজেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ আলহাজ জুলফিকার মিয়া।
আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন লালমোহন বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক আলী আহমদ বেপারী, ভোলা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ড আহবায়ক সাংবাদিক হাসিব রহমান ও লালমোহন প্রেসক্লাব সভাপতি আব্দুস সাত্তারসহ নাসরিন দুর্ঘটনায় স্বজন হারানো পরিবারের সদস্যরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *