বার্তা কক্ষ : ১৯৭১-এ মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনা আর তাদের এদেশীয় দোসরদের কলঙ্কজনক নৃশংসতা দেখেছে এই বাংলাদেশ। এরপর ১৯৭৫, মধ্য আগস্টের কালরাতে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয় নিদারুণ হিংস্রতার ছোবলে। শিশু রাসেলও রেহাই পায়নি নিষ্ঠুর শ্বাপদদের হাত থেকে। জগৎজুড়ে এত নির্মমতা দেখে মনে হয় ‘পৃথিবীর গভীর, গভীরতর অসুখ এখন’।
মানুষের মধ্যে এই হিংস্রতার ব্যাখা বিজ্ঞান দিয়েছে এভাবে যে একজন হতাশ মানুষ নিজের হতাশাকে কাটাতে, নিজের অপ্রাপ্তিবোধের তাড়না থেকে নিজের চাইতে দুর্বল কাউকে বেছে নেয়। আর সেই দুর্বলের ওপর হিংস্রতা দেখিয়ে একধরনের মানসিক পরিপূর্ণতা পেতে চায়। এই তত্ত্বকে বলা হয় ‘ফ্রাস্ট্রেশন-অ্যাগ্রেসনহাইপোথিসিস’। এ কারণেই আমরা দেখি দুর্বল রাজনের ওপর অপেক্ষাকৃত সবলের আস্ফালন এবং হিংস্রতা।
জার্মান মনস্তত্ত্ববিদ এরিক ফ্রম তাঁর দ্য অ্যানাটমি অব হিউম্যান ডেস্ট্রাকটিভনেস বইতে নানা মাত্রায় মানুষের হিংস্র আচরণের কথা লিখেছেন। প্রাগৈতিহাসিক যুগের গুহামানব সম্পর্কে তিনি বলেন, সে সময় মানুষ ন্যূনতম হিংস্রতার প্রকাশ ঘটিয়ে সবচেয়ে বেশি সম্পদ ভাগ করে নিত। একজন একটি পশু শিকার করলে গোত্রের সবাই মিলে তা ভাগ করে নিত। তিনি বলেন, সহিংসতা মানুষের স্বভাবজাত কিন্তু সে সময় তা ছিল কেবল প্রতিরক্ষামূলক এবং নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনে। পরবর্তী সময়ে শ্রেণিধারণা, ভূরাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক কারণে মানুষ পরিবেশ আর প্রতিবেশের প্রভাবে অহিতকর মারাত্মক সহিংসতার চর্চা শুরু করে, যাকে তিনি বলেন ‘ম্যালিগন্যান্ট অ্যাগ্রেসন’। অর্থাৎ জন্মগত পাশবিক প্রবৃত্তিগুলো পারিপার্শ্বিকতার কারণে ফুটে বেরোয়।
এই পারিপার্শ্বিকতার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে পরিবার। মূলত একজন মানুষের আচরণের ক্ষেত্রগুলো অনেকাংশেই পরিবার নির্ধারণ করে দেয়। শিশু রাজনকে যারা নির্মমভাবে হত্যা করেছে তাদের মধ্যে এক পরিবারের কয়েক ভাই একসঙ্গে হিংস্রতা দেখিয়েছে, যা তাদের বেড়ে ওঠার বৈকল্যকেই প্রমাণ করে।
মোটা দাগে বলতে গেলে যেসব কারণে একজন মানুষের মধ্যে হিংস্রতা জন্ম নিতে পারে তা হলো:
* শিশু যদি সব সময় হিংস্রতা, নির্মমতা আর সংঘাতময় পরিবারে বেড়ে ওঠে।
* পরিবারের কোনো সদস্যের মধ্যে যদি অতিমাত্রায় নৃশংসতা থাকে।
* স্কুলে যদি সে ক্রমাগত নিষ্ঠুর আচরণ বা উত্ত্যক্তের শিকার হয় বা কোনো শারীরিক, মানসিক বা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়।
* টেলিভিশনে বেশি বেশি নৃশংস চলচ্চিত্র দেখলে বা সংঘাতময় ভিডিও গেম খেললে
* সামাজিক অস্থিরতা আর সহিংসতার মধ্যে বড় হতে থাকলে।
* যূথবদ্ধ হিংস্রতার মধ্যে পড়ে গিয়ে একজন সাধারণ মানুষের মনের কোণে লুকিয়ে থাকা সহিংসতা প্রকাশ পেয়ে যেতে পারে।
* যদি কেউ মনে করে যে এই হিংস্রতার জন্য আমার কোনো বিচার হবে না, আমি পার পেয়ে যাব।
* রাষ্ট্রযন্ত্র বা সমাজ যদি নিপীড়কদের প্রশ্রয় বা বাহবা দেয়।
* অসুস্থ প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে কোনো কিছু অর্জনের চেষ্টা।
* অযোগ্য ব্যক্তি যদি আধিপত্য পেয়ে যায় তখন সে নৃশংসতাকে তার আধিপত্য ধরে রাখতে ব্যবহার করে।
* দীর্ঘদিনের হতাশা, অপ্রাপ্তিবোধ আর বঞ্চনার শিকার হলে।
* মনের ইচ্ছাগুলো যদি স্বাভাবিক উপায়ে নিবৃত্ত করা না হয়।
* ব্যক্তিত্বের বিকার বা মাদকের প্রভাবে।
হিংস্র হওয়া থেকে নিজেদের রক্ষা করতে হলে সবার আগে প্রয়োজন পরিশীলিত পারিবারিক কাঠামো। পাশাপাশি অন্যান্য রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার। শিশুর জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে। তাকে দিতে হবে নৈতিক শিক্ষা। শিশুর সামনে এমন কোনো বিষয়কে উৎসাহিত করা যাবে না যাতে সে মনে করে হিংস্রতাই সক্ষমতা। শিশুকে বোঝাতে হবে সফলতার মতো ব্যর্থতাও জীবনের
একটি অনুষঙ্গ।
হতাশার মধ্যে বেড়ে ওঠা চলবে না। প্রচারমাধ্যমকে হতে হবে দায়িত্বশীল। সহিংসতা বা হিংস্রতার সংবাদ এমনভাবে পরিবেশন করতে হবে, যাতে হিংস্র আচরণকারী কখনোই ‘হিরো’ হয়ে না ওঠে এবং এই সংবাদ থেকে কেউ যেন সহিংসতায় উৎসাহিত না হয়। শিশু, কিশোর বা পূর্ণ বয়স্ক কারও মধ্যে হিংস্রতার বহিঃপ্রকাশ দেখলে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়ে তাকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করতে হবে, প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে।
এত নির্মমতা-হিংস্রতার মধ্যেও কিন্তু সারকথা আমরা মানুষ। সহিংসতা আমাদের পরিচয় নয়। সেই কারণে গুটি কয় হিংস্র ‘মানুষের’ বিপরীতে সব সময় দাঁড়িয়ে যায় কোটি প্রাণ। তাই তো ২০০০ সালে ব্যারেন্টস সাগরে ডুবে যাওয়া ‘কুরস্ক’ নামের ডুবোজাহাজের আটকে পড়া মানুষের জন্য চোখের পানি ফেলেন বাংলাদেশের একজন মা। জীবনানন্দ দাশ লিখে গেছেন ‘এই পৃথিবীর রণ রক্ত সফলতা সত্য/ তবু শেষ সত্য নয়’। হিংস্রতা নয়, মানবতাই হোক মানুষের প্রকৃত পরিচয়।