Shadow

শেষ নিবাস

শেষ নিবাস -লেখক— গাড়ি বারি সুন্দর প্রাসাদ,পাইয়া সুন্দর নারি– দুই দিনের এই দুনিয়া এক দিন, যাইতে হবে ছারিরে মন যাইতে হবে ছারি — বৃদ্ধনিবাস ধারণাটি পশ্চিমা বিশ্বের। বিগত শতকের শুরু থেকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক, আধুনিক, গতিশীল জীবনযাত্রার উত্তরণ এবং একান্ন পরিবারভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার ক্রমাগত ক্ষয় প্রাপ্তির প্রত্যক্ষ ফল এসব বৃদ্ধাশ্রম। আজকাল আমাদের দেশেও বৃদ্ধদের জন্য এমন নিবাস গড়ে তোলা হচ্ছে। কিন্তু পশ্চিমে যা স্বাভাবিক জীবনযাত্রার উপকরণ, আমাদের দেশে তার বাস্তবতা ভিন্ন। এখানে এখনো ব্যক্তি থেকে পরিবারের গুরুত্বই বেশি। পূর্বের একান্নবর্তী ব্যবস্থা এখন খুব একটা না দেখা গেলেও অন্তত পিতা-মাতাকে নিজের পরিবারের অন্তর্ভুক্ত হিসেবেই গণ্য করা হয়। ব্যক্তি-স্বাধীনতার স্বাচ্ছন্দ্যের চেয়ে পরস্পরের সান্নিধ্যের শান্তিটুকুর মূল্য এখানে অনেক বেশি। তাই ছেলে বা মেয়ে স্বাবলম্ব্বী হলেই পিতা-মাতাকে ত্যাগ করে নিজে একা একা চলবে বা পিতা-মাতাকে আলাদা রেখে নিজে আলাদা থাকবে এটা প্রত্যাশিত নয়। এখানে সন্তান সাবালক হলেই পিতা-মাতার দায়িত্ব শেষ হয় না, তেমনি পিতা-মাতা বৃদ্ধ হলে এবং কর্মক্ষম না হলে, তার দেখাশোনা করার সামাজিক দায়ভার সন্তানের ওপরই বর্তায়। বৃদ্ধাশ্রম আমাদের দেশে সংস্কৃতির অংশ নয়, বরং কিছুটা প্রয়োজন এবং অনেকটাই মূল্যবোধের অবক্ষয়ের প্রকাশ। আমাদের এখানে যারা বৃদ্ধাশ্রমে থাকেন তাদের বেশির ভাগই যে স্বেচ্ছায় থাকেন তা নয়। অনেকেই সন্তানের অবহেলা বা অযত্নের কারণে, কখনো কখনো দুর্ব্যবহারের শিকার হয়ে আশ্রয় নেন এসব নিবাসে। আজ যারা বৃদ্ধ তারা নিজেদের জীবনের সব সময়, ধনসম্পদ বিনিয়োগ করেছিলেন সন্তানের জন্য, নিজের জন্য রাখেননি কিছুই। কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে সন্তানের কাছ থেকে এর একটি ক্ষুদ্র অংশও তারা পাচ্ছেন না। কখনো দেখা যায় সন্তান তার নিজের পরিবারের খরচ জোগাতে হিমশিম খাচ্ছে, তাই পিতা-মাতাকে মনে করছে বোঝা। নিজে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে একটু ভালো থাকার জন্য বাবা-মাকে ঠাঁই করে দিয়েছেন বৃদ্ধাশ্রমে। আবার এমনও দেখা যায়, সন্তানের টাকা-পয়সার অভাব নেই, কিন্তু পিতা-মাতাকে নিজের কাছে রাখার প্রয়োজনবোধ করছেন না। হয় নিজেই পাঠিয়ে দিচ্ছেন বৃদ্ধাশ্রমে, নয়তো অবহেলা-দুর্ব্যবহার করে এমন অবস্থার সৃষ্টি করছেন যেন তাদের পিতা-মাতা নিজেরাই সরে যান তার সাধের পরিবার থেকে। একবার বৃদ্ধনিবাসে পাঠাতে পারলেই যেন সব দায়মুক্তি। অনেক নামি-দামি বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিক্ষক, চাকরিজীবী যারা এক সময় খুব বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী ছিলেন, বৃদ্ধ বয়সে এসে নিজের সন্তানের দ্বারাই অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হয়ে বৃদ্ধাশ্রমের স্থায়ী বাসিন্দা হতে বাধ্য হচ্ছেন। অনেক সন্তান বা আত্মীয়স্বজন আর তাদের কোনো খবরও নেন না।
অনেকের জন্য বৃদ্ধনিবাস আসলেই অতি প্রয়োজনীয় বিকল্প। অনেক বৃদ্ধ আছেন যার সন্তান নেই, নেই কোনো নিকটাত্মীয় যার কাছে তিনি শেষ দিনগুলো কাটাতে পারেন। অনেকের সন্তান থাকলেও দেখা যায় তার আর্থিক সামর্থ্য নেই পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ করার। বৃদ্ধাশ্রমে তাদের জীবন আরেকটু আনন্দময় হবে চিন্তা করেই হয়তো তারা বুকে পাথর বেঁধেই পিতা-মাতাকে সেখানে পাঠিয়ে দেন। অনেকের আবার সন্তান কাজ করেন দেশের বাইরে। তারা টাকা পাঠাতে পারলেও পিতা-মাতাকে সময় দেওয়া আসলেই সম্ভব হয় না। সেই সঙ্গে অনেকেই জীবন সায়াহ্নে এসেও স্বাধীনচেতা, সন্তানের ওপর নির্ভরশীল থাকাকে এক ধরনের বোঝা মনে করেন, তাই নিজেরা স্বেচ্ছায় বৃদ্ধনিবাসে চলে যান। এদের জন্য বৃদ্ধনিবাস এক চমৎকার ব্যবস্থা। থাকা-খাওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে, শেষ জীবনের অবসর সময়টুকু উপভোগের সুযোগ করে দেয় এসব বৃদ্ধাশ্রম। এখানে যারা থাকেন, তারা সবাই মিলে একটা নতুন পরিবার তৈরি করে নেন। সমবয়সীদের সঙ্গে হেসে-খেলে, স্মৃতিচারণ করে তাদের সময়টা ভালোই কেটে যায়। আবার প্রয়োজনমতো নিজের পরিবারের সঙ্গেও দেখা-সাক্ষাৎ করেন, নানা পালা পার্বণে সন্তান নাতি-নাতনির সঙ্গে আনন্দমুখর সময় কাটান। বৃদ্ধাশ্রম অবহেলিত বৃদ্ধদের জন্য শেষ আশ্রয়। তাদের সারা জীবনের অবদানের যথার্থ স্বীকৃতি, শেষ সময়ের সম্মান ও নিরাপত্তা দেওয়া হয় এসব বৃদ্ধাশ্রমে। এখানে তারা নির্ভাবনায়, সম্মানের সঙ্গে, আনন্দের সঙ্গে বাকি দিনগুলো কাটাতে পারেন। বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় পাওয়া যায়, সঙ্গীসাথী পাওয়া যায়, বিনোদন পাওয়া যায়, কিন্তু শেষ জীবনের এই পরম আরাধ্য আনন্দটুকু পাওয়া যায় না। আর তাই তারা এই সময়টাতে প্রবল মানসিক যন্ত্রণা আর ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে ওঠেন।
নেহায়েত অনন্যোপায় হয়ে, ইচ্ছার বাইরে যারা বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠান, তাদের কথা ভিন্ন। কিন্তু যারা নিজের পর্যাপ্ত সম্পদ ও সময়-সুযোগ থাকার পরও শুধু অবহেলা করে পিতা-মাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিয়ে ভুলে যান, তাদের স্মরণ রাখা দরকার—এমন সময় তাদের জীবনেও আসতে পারে। যে বাবা-মা একসময় নিজে না খেয়েও সন্তানের মুখে তুলে খাইয়ে দিতেন, তারা আজ কোথায় কেমন আছেন সেই খবর নেওয়ার সময় যার নেই, তার নিজের সন্তানও হয়তো একদিন তার সঙ্গে এমন আচরণ করবে। বিভিন্ন উৎসবে, যেমন ঈদের দিনেও যখন তারা তাদের সন্তানদের কাছে পান না, সন্তানের কাছ থেকে একটি ফোনও পান না, তখন অনেকেই নীরবে অশ্রুপাত করেন আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। এমনকি সেই সন্তানকে অভিশাপ দিয়ে কামনা করেন যে, তার সন্তান তার সঙ্গে যে আচরণ করল, ভবিষ্যতে তার ছেলের সন্তানও যেন একই আচরণ করে। তাই আগামী প্রজম্মকে বলি প্রস্তুত থাকো তোমাদের জিবনেও এই দিন আসতে পারে।যেহেতু এই দিন দিন নয়, আরো দিন আছে।।দোয়া করি বাবা – মাকে নিয়ে সবাই ভালো থাকবে এটাই হোক আগামী দিনের প্রত্যাশা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *