Shadow

হুমকির মুখে পারিবারিক নিরাপত্তা বাচার নিচয়াতা কোথায় ?

চাঞ্চল্যকর চার শিশুর হত্যার ঘটনার রেশ এখনও শেষ হয় নাই। কিন্তু শিশুর প্রতি সহিংসতা চলমান রহিয়াছে, পারিবারিক সম্পর্কের দৃঢ়তার ধারণা আজ ভঙ্গুর হইয়া পড়িয়াছে। শুক্রবার মুন্সীগঞ্জে স্বামীর ধরাইয়া দেওয়া আগুনে স্ত্রীর মৃত্যু হইয়াছে। বৃহস্পতিবার পিরোজপুরের কাউখালিতে নারীর পায়ের রগ কর্তন করিয়াছে দুর্বৃত্তরা, ঘটনাদৃষ্টে মনে হইতেছে বিবাহ বিচ্ছেদের জের হিসাবে সাবেক স্বামীই এই কাণ্ড করিয়াছে। ইহার পূর্বে ডিসেম্বর মাসে নীল ফামারীর এক মা দুই শিশুকন্যাকে হত্যা করিয়া নিজেও আত্মহত্যা  করিয়াছেন। পহেলা ফেব্রুয়ারি সকালে রমনার বেইলি রোডের একটি বাসার চারতলা থেকে সদ্য ভূমিষ্ঠ নবজাতককে ফেলে দেয় শিশুটির গৃহকর্মী মাতা, ২৪ দিন লড়াই করিয়া সেও মৃত্যুবরণ করিয়াছে। ১৯ ফেব্রুয়ারি পিরোজপুর শহরের এক শিশুকে পানির সঙ্গে ইঁদুরের ওষুধ খাওয়াইয়া নিজেও আত্ম হননের পথ বাছিয়া লইয়াছেন। একটি হিসাব অনুযায়ী গত চার বছরে ১ হাজার ৮৫ জন শিশু হত্যার শিকার হইয়াছে, আর এই বছরের প্রথম দুই মাসে এই সংখ্যা ৪৯ জন-এ আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। গত কয়েক মাসের নানান অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সঙ্গে যোগ হইয়াছে রাজধানীর বনশ্রীর দুই শিশু হত্যার ঘটনাটি। এখন পর্যন্ত জানা তথ্য মোতাবেক, শিশু দুইটির মাতাই এই হত্যার ঘটনাটি ঘটাইয়াছেন। পৃথিবীর নানান দেশে সংস্কৃতি ও জীবনাচরণে পার্থক্য থাকিতে পারে, কিন্তু এই বিষয়ে সর্বত্র মতৈক্য রহিয়াছে যে, শিশু সন্তানের নিকট নিরাপদ আশ্রয়ের স্থান হইলো তাহাদের মাতা। বাস্তব সত্যি এই ধারণা যেন ভাঙিয়া পড়িবার উপক্রম হইয়াছে ।এই ঘটনাটির কারণে, সকলেই বলিতেছে ইহা অবিশ্বাস্য, অসম্ভব! কিন্তু ঘটনা তো ঘটিয়াই চলিয়াছে।

এইসকল ঘটনা বার্তা দিতেছে যে চিরন্তন পারিবারিক বন্ধন আলাদা হইয়া পড়িতেছে আর নিশ্চিন্ত আশ্রয়ের স্থান নষ্ট হইয়া যাইতেছে। সমাজের কোন গভীরতম সংকট এই রকম ঘটনা ঘটাইবার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করিয়া রাখিয়াছে, তাহা নিয়া সমাজতাত্ত্বিক ও মনস্তাত্ত্বিকরা মাথা ঘামাইয়া কূল পাইতেছেন না। বনশ্রীর মাতা মাহফুজা মালেক জেসমিন নাকি হত্যাকাণ্ডের কারণ হিসাবে উল্লেখ করিয়াছেন, তাহার কাছে মনে হইয়াছে বড় হইয়া শিশু দুইটি সমাজে যথাযথ ভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করিতে পারিবে না, তাই তিনি তাহাদের হত্যা করিয়াছেন। কিন্তু এই স্বীকারোক্তি যথেষ্ট নয়। ইহার ভিত্তিতে কোনো উপসংহারে পৌঁছাও যাইবে না। কিন্তু ইহা সত্য যে শিশু দুইটি সব চাইতে আপন জনের উপস্থিতিতেই হত্যাকাণ্ডের শিকার হইয়াছে।

শিশুর শিক্ষা আজ চরম প্রতিযোগিতাময়, প্রকৃত শিক্ষা ও জ্ঞানের চেয়ে চারিদিকে কেবল গ্রেডের জন্য উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াদৌড়ি। শিশুদের চেয়ে পিতামাতার অধিক নাভিশ্বাস পরিস্থিতি। ইহার চাপে হয়তো জেসমিন ভাঙিয়া পড়িয়াছেন। যদি জেসমিন সত্যি সত্যিই এই ঘটনা ঘটাইয়া থাকেন, তাহার কৃত কর্মের বিচার হইতে হইবে। ইহা চরম নিন্দনীয় একটি ঘটনা। হয়তো মানসিক বিকারও এইক্ষেত্রে থাকিতে পারে। কিন্তু কেবল আইন দিয়া এই বিপর্যয়ের কারণ বোঝা যাইবে না। কী কারণে এই রকম একটি ঘটনা ঘটিতে পারে তাহা গভীরভাবে সকলকেই ভাবিতে হইবে এবং করণীয় নির্ধারণ করিতে হইবে। আমাদের দরকার শিশুর জন্য সুন্দর এক পৃথিবী, মায়ের জন্যও নির্ভর এক পরিবেশ থাকিতে হইবে। রাষ্ট্র ও সরকার, আইন ব্যবস্থা, পুরুষ তান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা, সকল কিছুর মধ্যেই এই বিবেচনাগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করিতে হইবে। আমাদের দেখিতে হইবে সামাজিক ন্যায় বিচারের অভাব, ভোক্তা সংস্কৃতি, সামাজিক প্রতিষ্ঠার চাপ, ক্ষমতা ধরের সর্বগ্রাসী দাপট আমাদের সাধারণ নাগরিকদের কিরকম পর্যুদস্ত করিয়া তুলিয়াছে।! অন্যায় ও বৈষ্যমের পাহাড়ের নীচে সামান্য মানুষেরা কিরকম চাপা পড়িতেছে।! অসহায় মানুষের নিভিয়া যাইবার পূর্বের দপ করিয়া জ্বলিয়া উঠিবার প্রকাশ ভঙ্গিই হইতেছে বিকারময় ক্রোধ। আর এই দুর্বলের ক্রোধের শিকার তো আর সবল হইবে না, হইবে ততোধিক দুর্বল কেহ। তাই সমাজের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ চুয়াইয়া চুয়াইয়া নিম্নগামী শিকার হইতেছে নারী, কিংবা ততোধিক দুর্বল শিশু। তাই সমাজের অন্তর্গত বিকার দূর করিতে আমাদের কাজ করিতে হইবে। দুর্বলতমের যত্ন সবচাইতে বেশি লইতে হইবে। সমাজের ক্ষমতা ধরদের মধ্যে যাহাদের সংবেদনশীলতা অবশিষ্ট রহিয়াছে, কিংবা সমাজের ধারক-বাহক যাহারা, এইক্ষেত্রে তাহাদেরই দায়িত্ব সবচাইতে বেশি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *