Shadow

আজ হুল: সাঁওতালরা আজও ফিরে পায়নি অধিকার

উদিসা : প্রায় দুইশ’ বছর আগে ‘জমি চাই মুক্তি চাই’ স্লোগানে বিদ্রোহ ঘোষণা করলেও আজও অধিকার ফিরে পায়নি সাঁওতাল জনগোষ্ঠী। নতুন নতুন শাসকের কাছে বারবারই তাদের অর্থনৈতিক শোষণের পাশাপাশি সামাজিক শোষণ, বঞ্চনা ও অস্পৃশ্যতার শিকার হতে হয়েছে। কালের গহ্বরে হারিয়েছে ভিটে, জমি এমনকি ভাষা। বেদখল, সহিংসতা, মিথ্যা মামলা, জাল দলিল, হয়রানি তাদের প্রতিনিয়ত ঠেলে দিচ্ছে ধ্বংসের দিকে। এমনকি তাদের নিজেদেরও অধিকার আদায়ে যে কয়েকটি সংগঠিত প্রচেষ্টা দাঁড় হয়েছে, স্বাধীন বাংলাদেশে তারাও বলিষ্ঠ কণ্ঠে এগিয়ে আসতে পারেনি নানা প্রতিকূলতায়।

প্রায় ১০ হাজার সাঁওতাল কৃষক মিলে ভারতের চব্বিশ পরগনায় ভাগনাদিহি গ্রামে এক গণসমাবেশ থেকে সাঁওতাল বিদ্রোহের ডাক দেয়। সাঁওতাল সমাজে এই বিদ্রোহ ‘হুল’ নামে পরিচিত। সেদিন ভাগনাদিহি গ্রামের সিধু, কানু, চাঁদ ও ভৈরব এবং দুই বোন ফুলমণি ও জানমণির নেতৃত্বে অত্যাচারী ও নিপীড়কদের প্রতাপশালী অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আর তাদের হারানো জমি পুনরুদ্ধার করে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠার শপথ নেয়: ‘আবুদ শান্তি বোন খজোয়া জমিবুন হাতা ওয়া’ অর্থাৎ ‘জমি চাই, মুক্তি চাই।’

সাঁওতার বিদ্রোহের মূলে ছিল ভূমির মালিকানা নিয়ে বিরোধ। সাঁওতালরা বংশ পরম্পরায় সম্পদের প্রথাগত সামাজিক মালিকানায় বিশ্বাস করত। এরপর জমিদারেরা জমির ওপর তাদের মালিকানার দাবি নিয়ে হাজির হয়। এছাড়া মহাজনী শোষণ তো ছিলই। মহাজনী সুদ বাড়ত চক্রবৃদ্ধি হারে। সুদ দিতে না পারলে মহাজনরা তাদের গরু-মোষ থেকে শুরু করে ভিটেমাটি পর্যন্ত কেড়ে নিতেন।

সাঁওতাল বিদ্রোহ ঘোষণার দিন ইংরেজ সরকার, কমিশনার, দারোগা, ম্যাজিস্ট্রেট ও জমিদারদের চরমপত্র পাঠানো হয় এবং ১৫ দিনের মধ্যে জবাব চাওয়া হয়। কিন্তু ইংরেজরা দমন-পীড়নের পথ বেছে নেয়। বিদ্রোহ দমনের নামে চালানো হয় নৃশংস হত্যাভিযান। সংগ্রামরত ভাগলপুরে নিহত হন চাঁদ ও ভৈরব। পরে সিধু ও কানুসহ অন্য নেতাদের ফাঁসি দেওয়া হয়। ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হয় সাঁওতালদের সব গ্রাম।

অনেক বেলা গড়ালেও বদলায়নি সাঁওতালদের ভাগ্য। কালে কালে শুধু বদলেছে শোষকের পরিচয়। জমি বেদখল হতে হতে আভ্যন্তরীণ শরণার্থীতে পরিণত হয়েছে তারা, সহিংসতা, মিথ্যা মামলা তাদের জীবনের অংশে পরিণত হয়েছে। নিজের দেশে, এই স্বাধীন মাটিতে তারা হারিয়েছে নিজেদের পরিচয়।

জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন বলেন, ‘আমরা অস্তিত্বের আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের দাবি সমতল আদিবাসীদের জন্য পৃথক ও স্বাধীন ভূমি কমিশন গঠন করতে হবে এবং আদিবাসীদের ওপর জুলুম-নির্যাতন, হত্যা ধর্ষণ, ভূমি দখল, উচ্ছেদ বন্ধে রাষ্ট্রকে ভূমিকা পালন করতে হবে।’

.

সাঁওতালদের র‌্যালি (ফাইল ফটো)তিনি আরও বলেন, ‘অর্থনৈতিক অঞ্চল বানানোর নামে আমাদের বাপ দাদাদের জমি দখল করা হচ্ছে। জোরপূর্বক এ উচ্ছেদের বিরুদ্ধে কথা বলা কেবল আদিবাসী সমাজের দায়িত্ব না। নতুন করে সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্মের বাপ-দাদার জমি কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম ঘোষণার মধ্য দিয়ে এবারের হুল উদযাপন করা হচ্ছে।’

জাতীয় আদিবাসী পরিষদের মানিক সরেন বৃহস্পতিবার বিদ্রোহ দিবস উপলক্ষে গোবিন্দগঞ্জের প্রতিবাদ সভায় উপস্থিত থাকাকালীন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এখানে ১৮৪২.৩০ একর জমি পাকিস্তান আমলে মহিমাগঞ্জ চিনিকলেরর নামে অধিগ্রহণ করা হয়, যার মধ্যে ১৫শ’ একর জমি আদিবাসীদের। এখন চিনিকল বন্ধ। এই জমিতে ইকোনোমিক জোন বানানোর কাজ করতে চায় সরকার। যদিও চিনিকল না হলে যার জমি তাকে ফেরত দেওয়ার কথা ছিল বলেই জামতাম।’
তিনি আরও বলেন, ‘আজকের এই দিনে আমরা চাই এই জমি যার যার ছিল তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হোক।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক জোবাইদা নাসরিন বলেন, ‘সাঁওতাল বিদ্রোহ প্রথম ব্রিটিশ বিরোধী বিদ্রোহ হলেও জাতীয়তাবাদী ইতিহাস সেটা স্বীকার করেনি। এই অস্বীকারের রাজনীতি এবং নিগ্রহ আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির পথকেও অমসৃণ করেছে।’

Save

Save

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *