Shadow

একই দেশে মুক্তিযোদ্ধা ও যুদ্ধাপরাধী কিভাবে?

একই দেশে মুক্তিযোদ্ধা ও যুদ্ধাপরাধী কিভাবে ?

(How Fighters and War Criminals belong to same Country?)

picture2                                                         সিরাজী এম আর মোস্তাক

তেলে-জলে মেশে না কোনো কালে,
আলো-আধাঁর সদা বিপরীতে চলে।
শত্রু-মিত্র রহে না একই আবাসে,
তবে মুক্তিযোদ্ধা-যুদ্ধাপরাধী কেমনে বাংলাদেশে?
১৯৭১ সালে রক্তাক্ত যুদ্ধের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। যুদ্ধকালে বাঙ্গালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ লাখ লাখ বাঙ্গালি জিম্মি ও কারাবরণ করেছে। প্রায় এক কোটি বাঙ্গালি ভারতে শরণার্থী হয়ে মানবেতর দিন কাটিয়েছে। যুদ্ধ চলাকালে লাখ লাখ বাঙ্গালি ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়েছে। এছাড়া কোটি কোটি নাগরিক জীবন-ঝুঁকি নিয়ে দেশেই অবস্থান করেছে। তারা ছলে-বলে-কৌশলে পাকবাহিনীর সাথে থেকেছে আবার মুক্তির জন্য সর্বাত্মক সংগ্রামও করেছে। তারাই ত্রিশ লাখ শহীদ হয়েছে ও দ্ইু লাখ নারী সম্ভ্রম হারিয়েছে। এভাবে দেশের প্রতিটি নাগরিক স্বাধীনতাযুদ্ধে সর্বাত্মক ভূমিকা পালন করেছে। তারা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। ঘাতক পাকবাহিনীই সকল হত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে। তারাই যুদ্ধাপরাধী। এদেশের যুদ্ধাক্রান্ত নাগরিক কেউ যুদ্ধাপরাধী বা মানবতাবিরোধী অপরাধী নয়। অতএব, বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধা ও যুদ্ধাপরাধী উভয় নয়; শুধু মুক্তিযোদ্ধা প্রজম্ম বিদ্যমান।
আবু জাফর শামসুদ্দিনের ‘কলিমুদ্দি দফাদার’ গল্পটি একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। লেখক এতে যুদ্ধকালে কলিমুদ্দি দফাদারের কর্মকান্ড ফুটে তুলেছেন। কলিমুদ্দি দফাদার পাক হানাদার বাহিনীর সাথে থাকলেও তার ভূমিকা একজন খেতাবধারী মুক্তিযোদ্ধার চেয়ে অনেক প্রাজ্জ্বল। কলিমুদ্দি দফাদারের মতো বাংলাদেশের কেউ যুদ্ধাপরাধী বা মানবতাবিরোধী অপরাধী নয়। মাননীয় দেশনেত্রী শেখ হাসিনা, তার স্বামী জনাব ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া, বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেসা মুজিব এবং বঙ্গবন্ধুর স্বনামধন্য পিতা-মাতাও যুদ্ধকালে দেশেই ছিলেন। এজন্য তারা কখনো যুদ্ধাপরাধী নয়। কলিমুদ্দি দফাদারের মতো তারাও মুক্তিযোদ্ধা। এমনিভাবে বাংলাদেশের ষোল কোটি নাগরিক কেউ যুদ্ধাপরাধী নয়, সবাই মুক্তিযোদ্ধা প্রজম্ম।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু মাত্র ৬৭৬ জন যোদ্ধাকে বিশেষ খেতাব দেন। এছাড়া অবশিষ্ট সবাইকে সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা ঘোষণা করেন। তিনি নিজেও একজন সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা বা বন্দী যোদ্ধা পরিচয় দেন। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এম এ জি ওসমানী ও জাতীয় চার নেতাও একইভাবে সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দেন। এ মহান শিক্ষা অনুসারে, উক্ত ৬৭৬ জন খেতাবধারী যোদ্ধা ছাড়াও দেশের সবাই মুক্তিযোদ্ধা, কেউ যুদ্ধাপরাধী নয়। বড়জোর বিশ্বাসঘাতক বা নেমকহারাম মীরজাফরের প্রজম্ম হতে পারে। যারা স্বার্থের জন্য শত লান্থণা ও পরাধীনতাও মেনে নিতে পারে। বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর স্বার্থের জন্য নবাব সিরাজুদ্দৌলার বিরূদ্ধে ষঢ়যন্ত্র করেছিল এবং বাংলা-বিহার-উড়িশ্যার স্বাধীনতা ইংরেজদের হাতে তুলে দিয়েছিল। আজ শত বছর পরও পৃথিবীতে মীরজাফর একজন বিশ্বাসঘাতক বা নেমকহারাম হিসেবে ধিকৃত; তবে যুদ্ধাপরাধী নয়। এ হিসেবে বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধা ও যুদ্ধাপরাধী নয় বরং মুক্তিযোদ্ধা ও বিশ্বাসঘাতক প্রজন্ম বিদ্যমান।
পৃথিবীর সর্বোচ্চ আদালত তথা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ১৯৭১ এর যুদ্ধাপরাধের বিচার চলছে। তাতে পাকিস্তানীদের পরিবর্তে শুধু বাংলাদেশীরা যুদ্ধাপরাধী সাব্যস্ত হয়েছে। বেশ কয়েকজনের ফাঁসি ও যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে। এখন পৃথিবীর সবাই জানে, বাংলাদেশীরাই আসল যুদ্ধাপরাধী; পাকিস্তানিরা নয়। বাংলাদেশী যুদ্ধাপরাধীরাই সকল হত্যা ও নারী ধর্ষণ করেছে। অর্থাৎ যুদ্ধাপরাধী দেলোওয়ার হোসেন সাঈদীরাই ত্রিশ লাখ হত্যা ও দুই লাখ নারী ধর্ষণ করেছে, পাকিস্তানিরা নয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তাই প্রমাণ হয়েছে। এতে বাংলাদেশের ষোল কোটি নাগরিক শুধু মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম নয়, যুদ্ধাপরাধী প্রজন্মও সাব্যস্ত হয়েছে। আর পাকিস্তানীরা নিরপরাধ ও বীর জাতি সাব্যস্ত হয়েছে।
বাংলাদেশে প্রচলিত দুই লাখ মুক্তিযোদ্ধা তালিকা ও কোটাতেও তাই প্রমাণ হয়েছে। এ তালিকায় বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চার নেতা, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এম এ জি ওসমানীসহ ত্রিশ লাখ শহীদ ও দুই লাখ সম্ভ্রমহারা নারীর নাম নেই। তারা কেউ মুক্তিযোদ্ধা নয়। শুধু তালিকাভুক্ত দুই লাখ মুক্তিযোদ্ধাই দেশ স্বাধীন করেছেন। রাষ্ট্রীয় সকল সুযোগ-সুবিধা শুধু তাদেরই জন্য। অন্য কেউ স্বাধীনতাযুদ্ধে অবদান রাখেননি। বঙ্গবন্ধুসহ তালিকা বহির্ভূত সবাই অমুক্তিযোদ্ধা বা যুদ্ধাপরাধী। আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ও তাই। বাংলাদেশের ষোল কোটি নাগরিক থেকে মাত্র দুই লাখ পরিবার ছাড়া বাকী সবাই অমুক্তিযোদ্ধা বা যুদ্ধাপরাধী প্রজন্ম।
অতএব বাংলাদেশীরা মুক্তিযোদ্ধা-যুদ্ধাপরাধী উভয় প্রজম্ম কিনা, তা স্পষ্ট করা উচিত। বাংলাদেশীরা মুক্তিযোদ্ধা হলে, মাত্র দুই লাখ তালিকা বা কোটা কেন? বাংলাদেশীরা যুদ্ধাপরাধী হলে, পাকিস্তানীদের পরিচয় কি? আন্তর্জাতিক আদালতের রায় সঠিক না বেঠিক? এসব প্রশ্নের উত্তরও অন্য প্রশ্নে, তাহলো- একইদেশে মুক্তিযোদ্ধা  ও যুদ্ধাপরাধী কিভাবে?
এ্যাডভোকেট, ঢাকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *