Shadow

এক-এগারোর জন্যে বেগম জিয়ার শিখণ্ডী ইয়াজউদ্দিন সরকারের দায় কি এড়ানো যাবে ?

: ২০০৭ সালের এগারোই জানুয়ারী তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি প্রফেসর ইয়াজউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে সামরিক এস্টাবলিশমেন্ট কর্তৃক রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের মূল কুশীলবদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্যে একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি মহান সংসদে উত্থাপন করেছেন ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারের বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন। তাঁর আগে-পরে সংসদে এই বিষয়ে উত্থিত বিতর্কে অংশ নিয়ে ক্ষমতাসীন জোটের আরো অনেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য এক-এগারোর কুশীলবদেরকে চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিপ্রদানের দাবি উত্থাপন করেছেন, কিন্তু মেননের দাবিটি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ এজন্যে যে ২০০৭ সালের আগস্ট মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত ন্যাক্কারজনক ঘটনাবলীর তদন্ত করার জন্যে ২০০৯ সালে যে সংসদীয় তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল সেটা মেননের নেতৃত্বেই তদন্ত সম্পন্ন করে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন পেশ করেছিল, এবং ঐ প্রতিবেদনেই এক-এগারোর ক্ষমতা দখলের আসল কুশীলবদেরকে চিহ্নিত করার জন্যে প্রথমবার বিচার বিভাগীয় তদন্তের সুপারিশ করা হয়েছিল। মেনন তাঁর নেতৃত্বাধীন তদন্ত কমিটির পুরানো সুপারিশটি বাস্তবায়নের দাবিই পুনর্ব্যক্ত করেছেন বলে এবারের বক্তৃতায় জানিয়েছেন। বলা বাহুল্য, ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকার গত সাত বছর ধরে ক্ষমতাসীন থাকা সত্ত্বেও ঐ সুপারিশ এদ্দিন অগ্রাহ্য হয়েছিল, প্রতিবেদনটিও ধামাচাপা পড়েছিল। এবার নতুন করে যে ইস্যুটা চাঙা হয়ে উঠেছে সেটার আসল মরতবা এখনো বোঝা না গেলেও ইংরেজী দৈনিক দি ডেইলী স্টারের সম্পাদক সহপাঠী-বন্ধু মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে চলমান হেনস্থা-অভিযানের সূত্র ধরেই এক-এগারো যে আবারো ক্ষমতাসীন সরকারের শীর্ষ-নেতৃত্বের মনোযোগের কেন্দ্রে এসে গেছে তা পরিষ্কার হয়ে গেছে। বিষয়টির আরো ইন্টারেস্টিং ডাইমেনশন হলো, দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি’র শীর্ষ নেত্রী থেকে শুরু করে আরো বহু নেতা সোৎসাহে এক-এগারোর কুশীলবদেরকে চিহ্নিত করে বিচার করার এই কোরাসে সুর মিলিয়েছেন। সড়ক ও সেতু মন্ত্রী ওবাইদুল কাদের মন্তব্য করেছেন, এক-এগারো নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলে ‘কেঁচো খুড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে আসবে’। এ-ধরনের মন্তব্য থেকে বোঝা যাচ্ছে, এক-এগারোর পেছনে বিরাট রহস্য রয়েছে যা জাতীয় স্বার্থে উদঘাটিত হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। সেজন্যে আমিও মেননের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠনের দাবির সাথে একাত্মতা ঘোষণা করছি।
যেটুকু এর মধ্যেই উদ্ঘাটিত হয়ে গেছে তা-ও প্রচন্ড গুরুত্ববহ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ‘সুরত’ গ্রহণ করে এক-এগারোর ঐ ছদ্মবেশী সামরিক সরকার ক্ষমতা দখল করলেও পরবর্তীতে সামরিক এস্টাবলিশমেন্ট যখন মাইনাস-টু ফর্মুলা বাস্তবায়নের মূল এজেন্ডা নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল তখন শেখ হাসিনাই যে প্রাথমিকভাবে তাদের আসল টার্গেট ছিল, এবং ঐটা যে প্রকৃতপক্ষে ’মাইনাস-ওয়ান’ মানে ’মাইনাস শেখ হাসিনা’ ফর্মুলা ছিল সেটাও ইতোমধ্যে উদ্ঘাটিত হয়ে গেছে। এই কারণেই ২০০১-২০০৬ মেয়াদের সদ্য-প্রাক্তন সরকারের প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়াকে প্রথমে গ্রেফতার না করে বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে সবার আগে গ্রেফতার করা হয়েছিল, এবং তাঁকে গ্রেফতার করার সময় যেভাবে টানা-হেঁচড়া করে অপমানজনকভাবে বাসভবন থেকে পুলিশের গাড়ীতে তোলা হয়েছিল ও জেলে গাড়ী থেকে নামানো হয়েছিল তার সাথে বেগম জিয়ার গ্রেফতারের ‘ভদ্র আদব-কায়দা ও তাজিম-পূর্ণ’ চিত্রটা সবার আরেকবার দেখা উচিত মনে করি। ঐ কুশীলব একজনের বয়ানেই পরবর্তীতে খোলাসা করা হয়েছে যে ’আচরণগত সমতা বিধানের’ জন্যেই নাকি বেগম জিয়াকে গ্রেফতারের প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। এটা অবশ্যই বলতে হবে যে ২০০৭-৮ সালের পুরো ঘটনাপ্রবাহে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়েছে বেগম জিয়া, তারেক রহমান এবং বিএনপিকেই। কিন্তু, সত্যের খাতিরে বলা প্রয়োজন, ১১ জানুয়ারীর মূল যে সামরিক অভ্যুত্থান সেটার প্রেক্ষাপট তৈরির দায়ভার থেকে কোন নির্মোহ বিশ্লেষক কখনোই বেগম জিয়া এবং তাঁর শিখন্ডীর ভূমিকা পালনকারী রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনকে দায়মুক্তি দিতে পারবেন না। এই দুজনের কারণেই এক-এগারোর সামরিক ক্ষমতাদখলের ঘটনা ঘটেছিল, পরের কয়েকমাসের ’মাইনাস-টু’ বা ‘মাইনাস-ওয়ানের’ ঘটনাপ্রবাহ ক্ষমতাগ্রহণের পরবর্তী পর্যায়ের প্রণীত পরিকল্পনা বা‘নীল-নকশা’ অনুসারে সংঘটিত হয়েছিল। নিচের ব্যাখ্যাটা দেখুন:
১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৬ সালের নির্বাচনগুলো সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও সত্যের খাতিরে স্বীকার করতে হবে যে ২০০১ এবং ২০০৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে এর অব্যবহিত পূর্বে ক্ষমতাসীন সরকারগুলো নিজেদের পছন্দসই চীফ এডভাইজারের নেতৃত্বাধীন করার জন্যে বহু হিসাব-নিকাশ করেছিল। সেজন্যেই ২০০১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হজ্বব্রত পালনকালে পবিত্র মদীনা নগরী থেকেই মার্চ মাসে আগাম নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে দেশে ফেরত এসে ঐ ঘোষণা থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন, কারণ দেশে তাঁর পরামর্শদাতারা হিসাব-নিকাশ করে তাঁকে বুঝিয়েছিলেন যে অত্যন্ত দৃঢ়চেতা ব্যক্তিত্বের অধিকারী বিচারপতি মোস্তফা কামালের অধীনে নির্বাচন করার চাইতে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করে অপেক্ষাকৃত নরম স্বভাবের বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়াই আওয়ামী লীগের জন্যে অধিক সুবিধাজনক হবে। কিন্তু, তাদের ঐ হিসাব যে পরবর্তীতে ‘বুমেরাং’ হয়েছিল, সেটা এখন ইতিহাস। বিচারপতি লতিফুর রহমানকে সামনে রেখে কিভাবে বিএনপি-জামায়াতের ধুরন্ধর আমলা-বন্ধুরা ঐ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টার সহায়তায় শেখ হাসিনা সরকারের ‘সাজানো বাগান’ তছনছ করে পুরো মাঠ-পর্যায়ের প্রশাসনকে বিএনপি-জামায়াতপন্থী আমলাদের খপ্পরে নিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছিলেন সে কাহিনী ২০০১-৬ সালের বিএনপি-জামায়াত জোটের শাসনামলের ঐ কয়েকজন মহাদাপুটে আমলার বয়ানেই জানাজানি হয়ে গিয়েছিল; এবং তাঁরাই ঐ সরকারের আমলে মহাশক্তিধর অবস্থানে ছিলেন। ঐ পাঁচ বছরে বিএনপি-জামায়াতের ‘থিংক ট্যাংক’ সরকারী প্রশাসন, সেনাবাহিনী ও পুলিশবাহিনী থেকে মুক্তিযোদ্ধা এবং আওয়ামী লীগের গন্ধধারী প্রায় সকল কর্মকর্তাকে যে সুপরিকল্পিত ‘উইচ-হান্টিং’-এর মাধ্যমে ছেঁটে ফেলার (নিদেনপক্ষে ওএসডি করে ফেলার) প্রাণপণ প্রয়াস চালিয়েছিল সেটাও এখন ইতিহাস। সবশেষে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ২০০৬ সালে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের সময় পছন্দসই প্রধান উপদেষ্টা পাওয়ার উদ্দেশ্যে বিচারপতিদের অবসরের বয়স ৬৫ বছর থেকে বাড়িয়ে ৬৭ বছর করার জন্যে সংবিধান সংশোধন করতে গিয়ে ধরা খেয়ে গেল। জিয়াউর রহমানের জাগদল ও বিএনপি’র আন্তর্জাতিক সম্পাদক হওয়ার পুরস্কার হিসেবে যে ব্যক্তিকে বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল তাঁকে ২০০৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের হিসাব-নিকাশ করেই চাকুরির ঐ মেয়াদ-বৃদ্ধি, সেটা জনগণের কাছে খোলাসা হয়ে যাওয়ায় যে ২০০৬ সালের অক্টোবরের প্রাণঘাতী সংঘাত সৃষ্টি হয়েছিল তা-ও এখন সারা বিশ্ব জানে। যেটুকু কাহিনীর পুনরাবৃত্তি আজকের কলামের জন্যে প্রয়োজন সেটা হলো ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরের দুপুর থেকে সংঘটিত নারকীয় নাটকের কাহিনী। ঐদিন দুপুরেই বিচারপতি হাসান রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনকে পত্র পাঠিয়ে জানিয়ে দিয়েছিলেন, সারা দেশে তাঁর বিরুদ্ধে যে আন্দোলন-সংগ্রাম চলেছে তার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহণ করবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পত্রটি পেয়ে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন জাতিকে এই মহাগুরুত্বপূর্ণ খবরটি জানানোর ব্যবস্থা না করে টেলিফোনে শুধু বেগম জিয়াকে খবরটি জানিয়ে দিয়েছিলেন, এবং আমার মত লক্ষ লক্ষ টেলিভিশন দর্শক এই ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী। কারণ, আমরা তখন টেলিভিশনের পর্দায় বিএনপি’র নয়া পল্টনের প্রধান কার্যালয়ের সামনের রাস্তায় ঐ দলের যে সমাবেশ চলছিল সেটার ছবি দেখছিলাম, মঞ্চে উপবিষ্ট ছিলেন বেগম জিয়া ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। আমাদের চোখের সামনেই বেগম জিয়া মোবাইলে টেলিফোনটি রিসিভ করে তাঁর বক্তৃতা না দিয়েই হন্তদন্ত হয়ে মঞ্চ থেকে নেমে গাড়ীতে উঠে বঙ্গভবনের উদ্দেশে রওনা হয়ে গেলেন। টিভি ভাষ্যকাররাও তাঁকে অনুসরণ করে ধারাভাষ্য দেওয়া অব্যাহত রেখেছিলেন ক্যামেরাসহ। গাড়ীবহর বঙ্গভবনের গেটে পৌঁছার পর বেগম জিয়া বঙ্গভবনে ঢুকে পড়লেন, সাংবাদিকরা গেটে অপেক্ষা করে বেগম জিয়ার এই রহস্যজনক আচরণের ব্যাখ্যা পাওয়ার আশায় থাকলেন। তাঁদের ক্যামেরায় আমরাও পুরো ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে রইলাম। প্রায় দু’ঘন্টা পর বেগম জিয়ার গাড়ী বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে তাঁর ক্যান্টনমেন্টের বাসায় চলে গিয়েছিল। আর, বিচারপতি হাসান স্বাস্থ্যগত অপারগতা দেখিয়ে প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানানোর খবরটি বঙ্গভবন থেকে মিডিয়াকে জানানো হয়েছিল রাত বারোটা নাগাদ। কিন্তু, ততক্ষণে প্রাণঘাতী রাজনৈতিক দাঙ্গায় ঢাকার বায়তুল মোকাররম সহ দেশের নানা এলাকায় ৫২ জন ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছিলেন। আমরা যারা টিভি ক্যামেরার সামনে সংঘটিত ঐ পৈশাচিক দাঙ্গার ছবিগুলো দেখেছিলাম তাদের বাকি জীবনে এই স্মৃতি বারংবার দুঃস্বপ্নের জন্ম দিতে থাকবে। সারা বিশ্বের কাছে এরকম লোমহর্ষক হত্যাকান্ড মুহূর্তেই প্রচারিত হয়ে গিয়েছিল, তাই ঐ ঘটনাগুলো জাতি হিসেবে আমাদের ইমেজকে কোথায় নামিয়েছিল তা-ও সবাইকে ভেবে দেখতে বলি। কিন্তু, যদি রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন বিএনপি’র ও বেগম জিয়ার বিশ্বস্ত সেবাদাসের ভূমিকা পালন না করে ২৮ অক্টোবর দুপুরেই পত্রের মাধ্যমে জানানো বিচারপতি হাসানের অপারগতাটুকু জাতিকে জানিয়ে দিতেন তাহলে এতগুলো প্রাণ কি ঝরে পড়তো? এখন সারা বিশ্ব জানে, তাঁর সাথে বেগম জিয়ার ঐ বিকেলের সিদ্ধান্ত মোতাবেকই ত্রয়োদশ সংশোধনীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদের অন্যান্য বিকল্পের সন্ধান না করে পরদিন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন রাষ্ট্রপতির দায়িত্বের অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিজেই গ্রহণ করেছিলেন। ঐ ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ পছন্দ না করলেও শেখ হাসিনা তা মেনে নিযেছিলেন, এবং উপদেষ্টামন্ডলীর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন।
রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনের ঐ পদক্ষেপ যে বেগম জিয়ার স্বার্থেই তাঁর পরামর্শ অনুসারে নেয়া হয়েছিল সেটা মাস দেড়েক পর একসাথে চারজন উপদেষ্টার পদত্যাগের মাধ্যমে সারা জাতি জানতে পেরেছিল। ঐ চারজন উপদেষ্টা ছিলেন লেঃ জেনারেল হাসান মসউদ চৌধুরী, ডঃ আকবর আলী খান, শফী শামী এবং এডভোকেট সুলতানা কামাল। তাঁদের অভিযোগ ছিল, উপদেষ্টামন্ডলীর সভায় সিদ্ধান্ত না নিয়ে জনাব ইয়াজউদ্দিন প্রায়ই এককভাবে সিদ্ধান্ত নিতেন, আবার উপদেষ্টামন্ডলীর সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত নিজের ইচ্ছামত বদলে ফেলতেন। এমনকি, সভাগুলোতে প্রায়ই তাঁর প্রেস সচিবকে অংশগ্রহণ করতে দিতেন। ঐ প্রেস সচিব নাকি প্রায়ই নিজে সিদ্ধান্ত নিয়ে রাষ্ট্রপতির ইচ্ছানুসারে সেটাই উপদেষ্টাদের ওপর চাপিয়ে দিতেন। এসব কারণ পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। সূলতানা কামাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সহপাঠী ছিলেন, তাঁকে পরবর্তীতে পদত্যাগের কারণ জিজ্ঞেস করে আরো গুরুতর অভিযোগ জানা গিয়েছিল। উপদেষ্টামন্ডলীর সভায় কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার পর উপদেষ্টাদেরকে সভায় বসিয়ে রেখেই নাকি ইয়াজউদ্দিন পাশের কামরায় গিয়ে সিদ্ধান্ত ঠিক আছে কিনা তা টেলিফোনে বেগম জিয়ার কাছ থেকে নিশ্চিত হয়ে নিতেন এবং ঐ কথোপকথন উপদেষ্টারাও শুনতে পেতেন। বেশ কয়েকবার বেগম জিয়ার মতামত জানার পর সভায় ফিরে সিদ্ধান্ত নাকি বদলেও দিয়েছেন তিনি। এসব অভিযোগ থেকে নিঃসন্দেহে প্রমাণ পাওয়া যায় যে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনের এহেন শিখন্ডীসুলভ আচরণ ঐ চারজন বিবেকবান মানুষের কাছে অসহ্য মনে হওয়াতেই তাঁরা পদত্যাগ করেছিলেন। তারপর তাঁদের জায়গায় যাঁদেরকে উপদেষ্টা মনোনীত করা হয়েছিল তাঁদের নিরপেক্ষতা ও সততা আগাগোড়াই প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। তাঁদের একজন পরবর্তীতে বিএনপি’র উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য হিসেবে যোগ দেওয়ায় বোঝা যায়, সন্দেহের কারণ যথার্থই ছিল।
একইসাথে, বিচারপতি আজিজ এবং নির্বাচন কমিশনের দুজন সদস্যের বিএনপির-পক্ষপাতিত্ব নগ্নভাবে ধরা পড়ে যাওয়ায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট নির্বাচন বয়কটের পথে এগিয়ে যায়, এবং বাম দলগুলোও নির্বাচন না করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু, ২২ জানুয়ারি ২০০৭ তারিখের একতরফা নির্বাচন করার ব্যাপারে বিএনপি-জামায়াত জোট গোঁ ধরে এগিয়ে যায়। ফলে, দেশে আরেকটি মারাত্মক গৃহযুদ্ধ-পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। দেশের সেনা এস্টাবলিশমেন্ট ঐ ব্যাপারে নাখোশ থাকায় বেগম জিয়ার ইচ্ছানুসারে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন ১১ জানুয়ারি ২০০৭ তারিখে সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফ জেনারেল মইন ইউ আহমদের জায়গায় লেঃ জেনারেল মাসুদউদ্দিন সহ বেশ কয়েকজন সিনিয়র জেনারেলকে ডিঙিয়ে মেজর জেনারেল রাজ্জাকুল হায়দারকে চীফ অব স্টাফ নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়ে তা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরু করে দিলেন। কিন্তু, আদেশ বঙ্গভবন থেকে বেরোবার আগেই ঐ সিদ্ধান্তের খবর জেনারেল মইন ইউ আহমদ ও লেঃ জেনারেল মাসুদউদ্দিনের কাছে পৌঁছে যায়। অতএব, তাঁরা সেনা-কনভয় নিয়ে যথাসময়ে বঙ্গভবনে পৌঁছে যান, এবং নিয়োগপত্রসহ প্রেস সচিবকে হাতেনাতে পাকড়াও করেন। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা গিয়েছিল যে ঐ নিয়োগপত্র টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে জনৈক জেনারেল তাঁকে এমন পিটুনী দেয় যে বেচারাকে বেশ কয়েকদিন হাসপাতালে মারাত্মক আহত হয়ে শয্যাশায়ী থাকতে হয়েছিল। এহেন বেধড়ক্ মারপিট প্রত্যক্ষ করে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন ক্ষমতা সমর্পণে আর বিলম্ব করেননি। এটাই ছিল এক-এগারোর ক্ষমতার পালাবদলের দিনের প্রকৃত ইতিহাস, যা তখনকার পত্র-পত্রিকায় কিছুটা রাখঢাক করে হলেও প্রকাশিত হয়েছিল। মাইনাস টু কিংবা মাইনাস ওয়ান–ওগুলো ক্ষমতাগ্রহণ-পরবর্তী নীল-নকশা, জানুয়ারির ১১ তারিখে অত পরিকল্পনা মোতাবেক ক্ষমতাবদল হয়নি। সেজন্যেই বলছি, এক-এগারোর পুরো কাহিনী উদ্ঘাটনের জন্যে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন অতীব জরুরি। ৮ মার্চ ২০১৬
লেখক : অর্থনীতিবিদ; কলামলেখক; প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *