Shadow

টিপু লঞ্চ মালিকের স্বেচ্ছাচারিতা ফুঁসে উঠেছে ঢাকা-হাতিয়া-মনপুরা চরফ্যাশন-বেতুয়া রুটের লাখো যাত্রী

মীর মোহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন ॥ বিগত তিন দশক ধরে ঢাকা-ভোলা-দৌলতখান-মনপুরা-হাতিয়া-চরফ্যাশন-বেতুয়া নৌ-রুটের কয়েক লাখ যাত্রীরা টিপু লঞ্চ মালিকের স্বেচ্ছাচারিতা ও ক্ষমতার কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। সম্প্রতি টিপু লঞ্চ মালিকের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে ভোলার মনপুরায় মানববন্ধন করেছে ব্যবসায়ী, জনপ্রতিনিধিসহ কয়েক হাজার মানুষ।
সূত্রে জাানা যায়, ঢাকা-ভোলা-দৌলতখান-মনপুরা-হাতিয়া-চরফ্যাশন-বেতুয়া নৌ-রুটে একক রাজত্ব করছে টিপু লঞ্চ মালিক পক্ষ। তাদের ধারে-কাছে কেউ যেতেই পারছে না। অন্য কোন কোম্পানী ওই রুটে লঞ্চ পরিচালনা করার চেষ্টা করলে টিপু লঞ্চের মালিক গোলাম কিবরিয়া টিপু তাদেরকে বিভিন্নভাবে হুমকি-ধমকী ও মামলা দিয়ে দাবিয়ে রাখেন। যাতে করে তার এই একক রাজত্বের মধ্যে অন্য কেউ প্রবেশ করতে না পারে। তার কাছে দক্ষিণাঞ্চলের ব্যবসায়ীসহ সাধারণ মানুষ জিম্মি হয়ে থাকার খবর একাধিকবার বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স, প্রিন্ট মিডিয়া এবং অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোতে সংবাদ প্রকাশিত হলেও কোন বাস্তবমুখি পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি প্রশাসন। উল্টো ওই গোলাম কিবরিয়া টিপু ভোলার এক রাজনৈতিক নেতার ছত্র-ছায়ায় থেকে আরো ব্যপরোয়া হয়ে উঠেছেন। তিনি আইন-আদালতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার এই ক্ষমতার কাছে এখানকার সবাই জিম্মি হয়ে আছেন। সম্প্রতি তার স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে মনপুরায় মানববন্ধন করেছে ব্যবসায়ী, জনপ্রতিনিধিসহ কয়েক হাজার মানুষ। কিন্তু তাতেও কোন সুফল বয়ে আনেনি। বরং মানববন্ধনে নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিদের নামের তালিকা করে তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করছেন টিপু।
এদিকে ওই মানববন্ধনে ৪নং দক্ষিণ সাকুচিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ওলি উল্লাহ কাজল বলেন, এ রুটে একটি মাত্র লঞ্চ হওয়ার কারণে টিপু কোম্পানির খাম-খেয়ালিপনার কারণে যাত্রীদের দূর্ভোগ পোহাতে হয় এবং মৎস্য ব্যবসায়ীদের মাছ সময়মতো গন্তব্যে না পৌঁছানোর কারণে ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, মনপুরা উপজেলার রামনেওয়াজ, জনতা বাজার, পচা কোড়ালিয়া, হাজিরহাট, সূয্যমুখী, মাস্টারহাট, মাঝেরহাট ও জংলার খালসহ মোট ৯টি আড়ৎ থেকে প্রায় ৩ কোটি টাকার মাছ লঞ্চযোগে ঢাকায় যায়। কিন্তু সঠিক সময়ে ওই সব মাছ ঢাকায় গিয়ে পৌছে না, এতে একদিকে আর্থিকভাবে লোকসান গুনছেন তারা, অন্যদিকে ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না ব্যবসায়ীরা। তাই এ রুটে ভোগান্তি কমিয়ে অন্য মালিক পক্ষের আরো কয়েকটি লঞ্চ চালুর দাবী করেন তারা।
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী উপকূলীয় এলাকা ভোলা হাতিয়া ও মনপুরার মানুষ প্রতিনিয়ত জীবন জীবিকার জন্য প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে বেচেঁ আছে। কারও ব্যবসা, কারও চাকুরী, কেউ বা আবার দিনমজুরি করতে উপকূল ছেড়ে পাড়ি জমান ঢাকা কিংবা দূরের কোন শহরে। কিন্তু কাংঙ্খিত গন্তব্যে পৌছানোর আগেই টিপু লঞ্চ মালিক ও স্টাফদের হাতে নানামুখি অত্যাচার ও লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়। নানান ভাবে নাজেহাল হতে হয় যাত্রীদের। বিভিন্ন ঘাট ঘুরে মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেছে এমভি টিপু লঞ্চ মালিকের একক রাজত্বের অজানা কথা।এই রুটে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে টিপু কোম্পানির মালিকানাধীন মাত্র একটি জলযান। তবে তিনি আরও কয়েকটি কোম্পানির লঞ্চ এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করছেন। ফলে টিপুর কড়াল গ্রাস থেকে বের হওয়ার কোন সুযোগ পাচ্ছে না উপকূলীয় লাখ লাখ মানুষ। তার কথাই শেষ কথা। এক্ষেত্রে বিআইডব্লিউটিএ কর্মকর্তা কর্মচারীরা অনৈতিক সুযোগ সুবিধা নিয়ে কোন অন্যায় অনিয়মের প্রতিকার করছেন না। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দীর্ঘদিন ধরে জলপথের যাত্রীদেরকে জিম্মি করে রেখেছে এমভি টিপু লঞ্চ মালিক পক্ষ। স্থানীয়রা জানান, বিভিন্ন সময়ে এসব রুটে নতুন নতুন কোম্পানির লঞ্চ নামানোর  প্রতিযোগিতার খবর পাওয়া গেলেও মেসার্স ফারহান নেভিগেশন কোম্পানি, মেসার্স আগরপুল নেভিগেশন এন্ড কোম্পানি, মেসার্স পানামা সিপিং লাইন্স, মেসার্স হাবিবা নেভিগেশন এন্ড কোম্পানির জাহাজ ছাড়া অন্য কোম্পানির লঞ্চ এ রুটে পার্মিট পায়নি। না পাওয়ার পিছনে রয়েছে টিপু কোম্পানির ক্ষমতার দাপট ও অনৈতিক প্রভাব। অভিযোগ রয়েছে, গোলাম কিবরিয়া টিপু ভোলার এক রাজনৈতিক ব্যক্তির ছত্রছায়ায় থেকে বিভিন্ন দপ্তরে প্রভাব বিস্তার করে যাচ্ছে। টিপুর দৌরাত্ম্যের কাছে অন্য কোন কোম্পানি রুট পারমিট না পাওয়ায় একচেটিয়া ব্যবসা করে যাচ্ছে। ফলে দক্ষিণাঞ্চলের লক্ষ লক্ষ মানুষ এমভি টিপু লঞ্চের মালিক গোলম কিবরিয়া টিপুর কাছে জিম্মি হয়ে আছে।
এসব বিষয়ে অনেক যাত্রী প্রতিবাদ করতে গিয়ে পঙ্গু জীবন জাপন এমনকি মিথ্যা মামলায় জেলও খেটেছেন। আবার অনেক যাত্রীকে নদীতে নিক্ষেপ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বোরহানউদ্দিন উপজেলার হেলাল উদ্দিন নামের একযাত্রীকে গোলাম রহমান টিপু গুলি করে পঙ্গু করে দিয়েছে। তিনি এখন ঢাকায় গুলশানে ভিক্ষা করছেন। টিপু কোম্পানির সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন কিংবা স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে পারছে না। ওই কোম্পানির মালিক এককালে সংসদ সদস্য ছিল। সেই সুবাধে বিভিন্ন সময় অস্ত্র নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েন প্রতিবাদী যাত্রীদের উপর। ৮০ দশকের বহুল আলোচিত জগনাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতা তিব্বত হত্যার অন্যতম আসামী। সেই গোলাম কিবরিয়া টিপু এখন উপকূলীয় লঞ্চ যাত্রীদের কাছে  মূর্তিমান আতংক।
এদিকে ওই নৌ-রুটে যাতে অন্য কেউ বে ক্রসিং-এর অনুমতি না নিতে পারে তার জন্য বেশ ক’বছর আগে ঢাকার আদালতে মামলাও করেছিলেন টিপু। ওই মামলা খারিজও হয়েছে। কিন্তু বিআইডব্লিউটি এ’র দূর্নীতিবাজ কিছু অসাধু কর্মকর্তার খামখেয়ালীপনার কারণে অন্য কেউ জাহাজ চালানোর সুযোগ পাচ্ছে না। এক মালিকের একক আধিপত্যের কারণেই ঢাকা-মনপুরা-হাতিয়া ও চরফ্যাশন রুটে দৈনিক মাত্র একটি লঞ্চ তার ইচ্ছেমতো যাতায়াত করে। নোয়াখালীর হাতিয়া, ভোলার মনপুরা, তজুমদ্দিন ও চরফ্যাশন উপজেলার লাখ-লাখ মানুষের জন্য যাতায়াতের মাধ্যম মাত্র একটি লঞ্চ।
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, হাতিয়া মনপুরা, বোরহানউদ্দিন ও চরফ্যাশনসহ আরো কিছু রুটে চলে গোলাম কিবরিয়া টিপুর লঞ্চ। আসা-যাওয়ার নেই কোন টাইম টেবিল। গন্তব্যে পৌছাতে ঘন্টার পর ঘন্টা প্রতীক্ষা করতে হয় সাগর পাড়ের মানুষকে। মাঝে মধ্যে কোন ধরণের ঘোষণা ছাড়াই যাত্রা বাতিল করে কর্তৃপক্ষ। ফলে মানুষের দুর্ভোগের শেষ থাকে না। অন্যদিকে বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও অভিযোগের শেষ নেই। তারা গোলাম কিবরিয়া টিপুর কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থ নিয়ে নতুন লঞ্চ নামানোর অনুমতি না দিয়ে নানান তালবাহানা করছে। অথচ টিপু কোম্পানির লঞ্চের তুলনায় অন্যান্যরা অরো বড়, নিরাপদ, বৈরী আবহাওয়ায় চলাচলের উপযোগী জাহাজ বানিয়ে পরিচালনার জন্য বিআইডাব্লিউটিএ অধিদপ্তরে গিয়ে উল্লেখিত রুটে জাহাজ চলাচলের অনুমতি পান নি।
তবে অন্যান্য কোম্পানির কর্তৃপক্ষ জানান, দেশের নৌপথে সরকার জাহাজ তৈরীর প্লান দেয়। সরকার অনুমোদিত প্লান এর বিপরীতে লগ্নি করে ব্যাংক। অথচ বিআইডাব্লিউটিএর অফিসারদের লোভের কারণে ব্যবসায়িরা ব্যবসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
আসছে কোরবানীর ঈদ। প্রতিবছরের ন্যায় এ ঈদেও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে টিপু লঞ্চ মালিক পক্ষ এমন আশঙ্কা করছেন ওই রুটে চলাচলকারী কয়েক লাখ মানুষ ও ব্যবসায়ীরা। টিপু লঞ্চের এই অত্যাচার, জুলুম, নির্যাতন বন্ধের জন্য প্রশাসনের কঠোর ও বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেয়ার দাবী জানিয়েছেন ওই রুটে চলাচলকারী ভূক্তোভুগীরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *