Shadow

ভোলায় ঘূর্ণিঝড় মিধিলি’র তান্ডব ॥ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ॥ বিধ্বস্ত প্রায় ৫ শতাধিক ঘরবাড়ী ॥ নিখোঁজ-১

শরীফ হোসাইন, চীফ রিপোর্টার ॥ উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় মিধিলি তান্ডব চালিয়েছে ভোলায়। প্রবল বৃষ্টি আর বাতাসের গতিবেগ নিয়ে দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তান্ডব চালিয়েছে পুরো জেলায়। এতে জেলা শহরসহ ৭ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অসংখ্য গাছপালা ভেঙ্গে পড়েছে। গাছপালা ভেঙ্গে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে বিভিন্ন এলাকা। বিধ্বস্ত হয়েছে অন্তত ৫ শতাধিক ঘরবাড়ী। মিধিলি’র তান্ডবে তজুমদ্দিন ও মনপুরায় ২টি ট্রলার ডুবির ঘটনা ঘটে। এতে ১ জেলে নিখোঁজ হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে দুপরের দিকে লক্ষ্মীপুরের মঝুচৌধুরীর ঘাটে যাওয়ার সময় কলমি লতা নামের একটি ফেরীর তলা ফেটে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। তবে কোন হতাহত কিংবা ক্ষয়-ক্ষতি হয়নি।
জানা গেছে, উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় মিধিলি তান্ডব চালিয়েছে ভোলায়। প্রবল বৃষ্টি আর বাতাসের গতিবেগ নিয়ে দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তান্ডব চালিয়েছে পুরো জেলায়। এতে জেলা শহরসহ ৭ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অসংখ্য গাছপালা ভেঙ্গে পড়েছে। গাছপালা ভেঙ্গে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে বিভিন্ন এলাকা। বিধ্বস্ত হয়েছে অন্তত ৫ শতাধিক ঘরবাড়ী। মিধিলি’র তান্ডবে তজুমদ্দিন ও মনপুরায় ২টি ট্রলার ডুবির ঘটনা ঘটে। এতে ১ জেলে নিখোঁজ হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। গাছপালা উপড়ে পরে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় পুরো জেলা অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছে। এ ছাড়াও গত ২৪ ঘন্টার ২৪৮.৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। অতি বৃষ্টিপাতের কারণে শহরের বিভিন্ন স্থানে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে।
আরো জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ভোলার মেঘনা ও তেঁতুলিয়ায় ৪-৫ ফুট নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীর মাছ ধরার অধিকাংশ ট্রলারসমূহ নিরাপদ আশ্রয়ে থাকলেও তজুমদ্দিন উপজেলার ৪ জেলে মলংচড়া সিডার চর থেকে মির্জাকালু ঘাটে আসার সময় সফিক মাঝির ট্রলার দূর্ঘটনার কবলে পড়ে। তীরের উদ্দেশ্যে আসার সময় মাঝ নদীতে পৌছলে ডেউয়ের ধাক্কায় নৌকাটি উল্টে যায়। পাশে মাছ ধরারত অন্য জেলেরা ৩ জেলেকে উদ্ধার করলেও বাদশা মিয়া (৫০) নামের এক জেলে নিখোঁজ হয়েছে। তার বাড়ি বড় মলংচড়া ইউনিয়নের বলে জানিয়েছে উদ্ধার হওয়া সফিক মাঝি। এছাড়া মনপুরায় একটি ট্রলার ডুবের ঘটনা ঘটে। এতে ওই ট্রলারে থাকা ৩ জেলেকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে কোষ্টগার্ড দক্ষিণ জোনের একটি টিম।
প্রায় অর্ধশতাধিক ঘেরের ও পুকুরের মাছ ভেসে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া মৌসূমি ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমান এখনও জানা যায়নি। অন্যদিকে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে ইটভাটা গুলোতে। তাদের প্রস্তুতকৃত কাঁচা ইট বৃষ্টির পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে। এতে তাদের কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে দুপরের দিকে লক্ষ্মীপুরের মঝুচৌধুরীর ঘাটে যাওয়ার সময় কলমি লতা নামের একটি ফেরীর তলা ফেটে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। তাৎক্ষনিকভাবে খবর পেয়ে ইউএনও’র নেতৃত্বে একটি দল ঘটনাস্থলে গিয়ে ফেরী থেকে পানি অপসারণ করে বিদপ মুক্ত করা হয় এবং পূনরায় ভোলার ঘাটে নিরাপদে ফিরিয়ে আনা হয়। তাই হতাহত কিংবা ক্ষয়-ক্ষতির ঘটনা ঘটেনি।
স্থানীয়সূত্রে জানা গেছে, তজুমদ্দিনের মেঘনা নদীতে ঘূর্ণিঝড় মিধিলীর প্রভাবে একটি জেলে ট্রলার ডুবির ঘটনা ঘটেছে। এতে বাদশা মিয়া (৫০) নামের এক জেলে নিখোঁজ রয়েছে। সে মলংচড়া ইউনিয়নের মৃত মজিবল হকের ছেলে। শুক্রবার বেলা ২ টার দিকে ৪ জেলেসহ নৌকা নিয়ে শফিক মাঝী মলংচড়া চর থেকে মির্জাকালু তীরে আসার সময় দূর্ঘটনার কবলে পড়ে।
উদ্ধার হওয়া শফিক মাঝী জানান, মলংচড়া চর থেকে আমরা ৪ জন তীরের উদ্দেশ্যে আসার সময় মাঝ নদীতে পৌছলে ডেউয়ের ধাক্কায় নৌকা উলটে ডুবে যায়। অন্য জেলেরা আমাদের তিনজনকে উদ্ধার করলেও বাদশা মিয়াকে পাওয়া যায়নি।
মলংচড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নুরনবী শিকদার বাবুল জানান, তিনি নৌকা ডুবির সংবাদ পেয়ে নিখোঁজ জেলেকে খুজতে বড় ট্রলার পাঠিয়েছেন। রাত পর্যন্ত নিখোঁজ বাদশা মিয়াকে পাওয়া যায়নি। তজুমদ্দিন থানা অফিসার ইনচার্জ মাকসুদুর রহমান মুরাদ বলেন, উপজেলা নির্বাহী অফিসার এর মাধ্যমে নৌকা ডুবির সংবাদ পেয়েছি। নিখোঁজ ব্যক্তিকে উদ্ধারের চেস্টা চলছে।
অন্যদিকে চরফ্যাশন উপজেলায় ঘূর্ণিঝড় মিধিলির তা-বে ২শ’ ১৯টি ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। এ ছাড়াও ভেঙ্গে পড়েছে শতাধিক গাছ। শুক্রবার (১৭ নভেম্বর) চরফ্যাশন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নওরীন হক বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
উপজেলার ঢালচর ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম হাওলাদার বলেন, ‘বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বৃষ্টি শুরু হয়ে রাতে আবহাওয়া খারাপ হয়। দুপুরের দিকে ঘূর্ণিঝড় মিধিলির দমকা হাওয়াসহ আঘাত হানে উপকূলের এই উপজেলায়। এটা অনেকটা টর্নেডোর মতো ছিল। পরে ঘূর্ণিঝড়টি ঢালচরের পূর্ব দিকে ধেয়ে যায়। এতে ঢালচর ইউনিয়নের বেশ কিছু ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয় ও গাছপালা উপড়ে যায়। এবং কিছু মাছ ধরার ট্রলারও ডুবে যায়। পরে জেলেদেরকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে আনা হয়।
উপজেলার বিচ্ছিন্ন দ্বীপ চরকুকরি-মুকররি ইউপি চেয়ারম্যান আবুল হাসেম মহাজন বলেন, ‘ঝড়ে তার ইউনিয়নের বহু ঘর-বাড়ি ল-ভ- হয়ে গেছে। টিনের ঘরের চাল উড়িয়ে নিয়ে গাছের ওপর ফেলেছে। কয়েকটি কাঁচা ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গাছপালা উপড়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্থদের তালিকা করা হবে।
ইউএনও নওরীন হক বলেন, ‘ঢালচর, চরকুকরি মুকরি, ও জাহানপুরসহ বেশ কিছু ইউনিয়নের ওপর দিয়ে ঘূর্নিঝড় বয়ে গেছে। এতে প্রায় ২শ’ ১৯ ঘর-বাড়ির ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তি এবং ক্ষয়ক্ষতির তালিকা দ্রুত তৈরি করে জেলায় পাঠানো হবে।
অপরদিকে, মধ্য মেঘনার অদূরবর্তী চরসমূহ মাঝের চর, দৌলতখানের মদনপুর, মেদুয়া, নেয়ামতপুর, তজুমদ্দিনের চর জহিরুদ্দিন, চর মুজাম্মেল, চর নাছরিন, চর শাওনে বসবাসরত পরিবারগুলোকে দুপুর থেকে ট্রলার যোগে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে আনা হয়েছে। এসব এলাকায় স্বাভাবিক জোঁয়ারের চেয়ে ৩-৪ ফুট পানিতে প্লাবিত হয়েছে। তবে ক্ষয়-ক্ষতির কোন খবর এখনও পাওয়া যায়নি।
ঘূর্ণিঝড় ‘মিধিলি’র কারণে ভোলা থেকে সব ধরনের লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ। ভোলার বিআইডব্লিউটিএর সহকারী পরিচালক মো. শহিদুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড় মিধিলের প্রভাবে সকাল থেকে ভোলায় দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া হওয়ায় জেলার ৭ উপজেলার (ভোলা-ঢাকা, ভোলার বোরহানউদ্দিন-ঢাকা, চরফ্যাশন-ঢাকা, লালমোহন-ঢাকা, মনপুরা-ঢাকা, ভোলা-লক্ষ্মীপুর, দৌলতখান-আলেকজান্ডার) সব রুটের লঞ্চ চলাচল বন্ধ করা হয়েছে। এটি পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ থাকবে।
মিধিলা’র তান্ডবে সার্বিক বিষয়ে ভোলার জেলা প্রশাসক আরিফুজ্জামান বলেন, ঘূর্নিঝড় মিধিলা’র তান্ডবে ভোলায় গাছপালা, ঘরবাড়ি ও ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং ২টি ট্রলার ডুবির ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় ৪ জেলেকে উদ্ধার করা হয়েছে। তবে একজন নিখোঁজ হওয়ার খবর পেয়েছি। সার্বিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমান নিরুপনের কাজ চলছে।
উল্লেখ্য, ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতি এড়াতে ভোলায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির জরুরি প্রস্তুতিসভা অনুষ্ঠিত হয়। বৃস্পতিবার (১৬ নভেম্বর) রাত ৯ টায় জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় সভাপতিত্ব করেন জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ভোলা জেলা প্রশাসক আরিফুজ্জামান। এ সময় তিনি জানান, যেকোনো ধরনের দুর্যোগে বড় ধরনের ক্ষতি এড়াতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। জেলার ৭ উপজেলায় খোলা হয়েছে ৮টি কন্ট্রোল রুম। প্রস্তুত রাখা হয়েছে ৮৬৯টি আশ্রয়কেন্দ্র ও ১২টি মুজিব কেল্লা। গঠন করা হয়েছে ৯২টি মেডিকেল টিম। এর সাথে জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে সুপেয় পানির ব্যবস্থা রাখতে বলা হয়েছে।
এছাড়া দুর্যোগ মোকাবিলায় পর্যাপ্ত শুকনো খাবার, ত্রাণের চাল ও নগদ টাকাসহ সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। বিভিন্ন দুর্গম অঞ্চলের ঝুঁকিপূর্ণ মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে আনাসহ তাদের সচেতন করার লক্ষে ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির আওতায় ১৩ হাজার সিপিপি, ৮০০ স্বেচ্ছাসেবক ও রেড ক্রিসেন্টের ২ হাজার স্বেচ্ছাসেবক কর্মী প্রস্তুত রয়েছে। পাশাপাশি প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে বিভিন্ন এনজিও সংস্থা গুলোকে। একই সাথে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার বেড়িবাঁধ যেনো ছুটে না যায় এর জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডকেও সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
এরই মধ্যে দুর্যোগ মোকাবিলায় জেলায় ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দ হয়েছে প্রায় ২০ লাখ টাকা। পাশাপাশি রয়েছে ৩৪১ টন চাল ও শিশু খাদ্যের জন্য ৯ লাখ ১০ হাজার টাকা এবং গো-খাদ্যের জন্য ৯ লাখ ৩০ হাজার টাকা বরাদ্দ। এছাড়া আবহাওয়া অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলেও জানান তিনি।
সভায় উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় উপ-পরিচালক তামিম আল ইয়ামিন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মামুন অর রশিদ, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) রিপন কুমার সাহ, ভোলা সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা তৌহিদুল ইসলাম, বিআইডব্লিউটিএ ভোলার সহকারী পরিচালক শহিদুল ইসলাম সহ বিভিন্ন প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও অনলাইন নিউজ পোর্টালের সাংবাদিকবৃন্দ।