Shadow

ভোলায় জেলে পল্লীগুলোর শিশুর কাঁধে সংসারের বোঝা

এম শরীফ হোসাইন, ভোল ॥ মেঘনার কোল ঘেষে দাঁড়িয়ে থাকা এক বিপন্ন জনপথ ঢালচর। যেখানে হাজারো জেলেদের বসবাস। নদী ভাঙ্গনে দিশেহারা ঐ জনপদের বসতি ছাড়া আর কিছু নেই। নদীতে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করাই তাদের প্রধান কাজ। পৈতৃক পেশাকে ধরে রেখেছেন উপকূলের হাজারো জেলে। শিক্ষার আলো পৌঁছালেও যেন শিক্ষা গ্রহণ না করেই জেলে হিসেবে গড়ে উঠছে শিশুরা। দারিদ্র্যের সংসারে একটু আয়ের আশায় এখানকার শিশুরা খুব কম বয়সেই বেছে নিতে বাধ্য হয় নদী ও জেলে জীবন। যেখানে তাদের এই বয়সে হাসি-খুশি ও আনন্দ-উল্লাসে বেড়ে ওঠার কথা, সেখানে শুধুই দারিদ্র্যের কষাঘাত। যে শিশুটির হাতে থাকার কথা ছিল বই, সেই শিশুটির হাতে আজ মাছ ধরার জাল। দিন কাটে তার নদীর বুকে। সন্তানদের পড়ালেখা করানোর প্রতি আগ্রহ নেই তাদের বাবা মায়ের। আধুনিক সভ্যতা থেকে পিছিয়ে পড়া এই জনপদের অভিভাবকদের অসচেতনতা ও নদী ভাঙ্গনের কারণে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারছে না এখানকার শিশুরা। উপকূলীয় অঞ্চলের জেলে পল্লীর অধিকাংশ শিশুদের জীবনের গল্প এমন।
সরেজমিনে দেখা যায়, জেলে নৌকায় কাজ করা অধিকাংশ শিশুর বয়স আট থেকে পনেরো বছর। জীবনের প্রয়োজনে তারা এই বয়সে হয়ে ওঠে দক্ষ মাঝি বা জেলে। এই শিশুদের কেউ বাবার সঙ্গে জাল টানে, কেউ নৌকার বৈঠা ধরে, কেউবা জাল থেকে মাছ ছাড়িয়ে ঝুড়িতে তোলে। আকৃতি অনুযায়ী মাছ বাছাই করার কাজও তারা করে। এভাবেই তারা নিচ্ছে দক্ষ জেলেতে পরিণত হওয়ার শিক্ষা। মাঝে মাঝে বাবার কাজের দায়ভারও তাদের বইতে হয়। ধরা মাছ নিয়ে বাবা হাটে গেলে বাবার অনুপস্থিতিতে উত্তাল নদীতে নৌকা নিয়ে চলে যায় শিশুটি। জোয়ার ভাটা ওদের মুখস্থ। দিন শেষে এই মাছ বিক্রি করে যা পায় তা দিয়ে কিছুটা হলেও উপকৃত হয় তাদের পরিবারের মানুষগুলো।
ভোলা সদর উপজেলার তুলাতুলি, ধনিয়া, কাচিয়া, শিবপুর রাজাপুর, ভেদুরিয়া। দৌলতখান উপজেলার মদনপুর, হাজীপুর। চরফ্যাশন উপজেলার ঢালচর, বক্সিঘাট, নলূয়া, চর পাতিলা, পাঁচ কপাট, আট কপাট, খেজুর গাছিয়া, ঘোষেরহাট, সা¤্রাজসহ অঞ্চলের জেলে পরিবারগুলোর সাথে আলাপ করে জানা গেছে, সেখানে প্রতিনিয়ত অনিশ্চতায় বিবর্ণ হয়ে ওঠে জেলে পল্লীর হাজারো শিশুর শৈশব। শিশু শ্রমের বেড়াজালে বন্দি জীবন আর বাবার কষ্টের সঙ্গী হতে ষষ্ঠ শ্রেণীতে আর পড়া হয় না অধিকাংশ শিশুর। ফলে কোমলমতি সব শিশুর কাঁধে ওঠে সংসারের বোঝা। বাবা-মা ছোট ভাইবোন নিয়ে বেঁচে থাকাই তাদের জীবনের মূলমন্ত্র। অনেক শিশুর স্কুলে যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও সম্ভব হয়ে ওঠে না।
ভোলা সদর উপজেলার তুলাতুলির চরে গিয়ে দেখা যায় নদীর মাঝে জাল ফেলছে ১৪ কি ১৫ বছরের শিশু মিজান। তার সাথে রয়েছে আরো দু’জন। যাদের বয়স ১০ কি ১২ হবে। মেঘনার বুকে মাছ ধরতে তারা। কথা হয় তাদের সাথে। এ সময় তারা বলেন, আমরা গরীব পরিবারের সন্তান। পরিবারের স্বচ্ছলতা যোগাতে বাধ্য হয়ে নদীতে মাছ শিকার করতে নেমেছি। পড়া-লেখা করার ইচ্ছা আছে, কিন্তু গরীব পরিবারে জন্মেছি তো ইচ্ছাটা মনের মাঝেই মাটি চাঁপা দিয়ে রেখেই এ কাজ করছি। যদি কখনো সুযোগ পাই তাহলে পড়া-লেখা করতে রাজি আছি। এ সময় নদীর কিনারে বেধে রাখা নৌকায় তাদের ভাত রাধতে দেখা গেছে। অপর একজনকে নদীর মাঝ খানে দেখা গেছে মাছ ধরায় ব্যস্ত। তার সাথে কথা বলতে ডাকলে বলে, ভাই জাল ফেলছি, একটু সময় লাগবে, অপেক্ষা করুন।
চরফ্যাশন উপজেলার ঢালচর ঘাটের কাছেই বাবার মাছ ধরার সঙ্গী হিসেবে ছিলেন ১০ বছরের শিশু বেলাল। বেলালের ভাষ্য ‘স্কুলে যাইতে তো ইচ্ছা করে তয় কামের লাইগ্যা যাইতে পারি না। জোয়ার আওয়ার আগেই জাল পাতি, আর ভাটায় পানি টানলে মাছ লইয়া আইতে আইতে স্কুল ছুটি হইয়া যায়।’
ঢালচর ঘাটেই কথা হয় আরো কিছু জেলে শিশুর সঙ্গে। রাকিব, ইসমাইল ও মহসিন নামের এই শিশুরাও বলছে, বাবার কাজের সঙ্গী হতে হয় বলেই তারা স্কুলে যেতে পারে না।
আট কপাট ঘাটের কয়েকজন জেলের সাথে কথা বললে তারা জানান, মাছ ধরা আমাদের পৈতৃক পেশা। এই পেশাকে ধরে রেখেছি এখানো। আমাদের সন্তানরা সেই পেশা ধরে রাখবে। ছেলে মেয়েদের পড়াশোনা করানোর খরচ নেই। তাই মাছ ধরার কাজ শিখাচ্ছি। ছেলেবেলা থেকে কাজ শিখলে বড় হয়ে একজন দক্ষ মাঝি হিসাবে নিজেদের গড়তে পারবে ওরা।
চর কুকরি-মুকরির জেলে বসির (৪৫) বলেন, ‘সব পরিবারই এখন বোঝে যে, তাগো পোলাপাইনগুলারে পড়ানো উচিৎ। কিন্তু প্যাডের (পেটের) তাগিদে সবাই তো পড়াইতে পারে না।’
চর কুকরি-মুকরি ইউপি চেয়ারম্যান আবুল হাসেম মহাজন জানান, ‘নৌকায় একজন জেলের পক্ষে জাল টেনে মাছ ধরা কষ্টকর। মাছ ধরতে হলে আরো লোকের দরকার হয়। দরিদ্র জেলেরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার পরিবারের মানুষগুলোকে সহকারী হিসেবে ব্যবহার করে। মূলত এই কারণে শিশুগুলোকে স্কুল ছাড়তে হয়।’
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘উপকূলীয় অঞ্চলে শিশুদের শিক্ষিত করতে হবে এমন প্রবণতা কম। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, এই অঞ্চলে দরিদ্র ও অভাবী মানুষের বিচরণ বেশি। শিশুদের শিক্ষিত করার প্রবণতা তখন বৃদ্ধি পাবে যখন সমাজ থেকে অভাব দূর করা যাবে। প্রতিটি শিশুর জীবনের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্পর্কে পরিবারকে সচেতন করতে পারলে কমে আসবে শিক্ষা বঞ্চিত শিশুর সংখ্যা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *