Shadow

লোকজ ঐতিহ্যের পিঠা টিকিয়ে রেখেছে মৌসুমী ব্যবসায়ীরা

জেলা সংবাদদাতা,মাদারীপুর: পিঠা শুধু লোকজ খাদ্য নয়, এটা বাংলা ও বাঙালির লোকজ ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে আবহমান বাংলার সংস্কৃতি। আধুনিকতার ছোঁয়ায় পারিবারিক ও সমাজ জীবন থেকে পিঠা তৈরির প্রচলন কমে যাচ্ছে। তবে এ ঐতিহ্য ধরে রেখেছে মৌসুমী পিঠা ব্যবসায়ীরা।

এখন আর বাড়ি-বাড়ি নয়, প্রতিদিন শহর ও শহরতলীতে শীতে বৈকালিক ও সান্ধ্যকালীন পিঠার দোকানে পিঠাপ্রেমীদের ভিড় দেখা যায়।

পথের পাশে তৈরি হচ্ছে ছিটা, ভাঁপা, চিতই, পুলি ও পাটিসাপ্টা পিঠা। পথচারীরা গরম গরম পিঠার স্বাদ উপভোগ করছে তৃপ্তিসহকারে। হরেক রকম পিঠা নিজেরা খাচ্ছে আবার কেউ কেউ বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে পরিবারের সদস্যদের জন্য। বিক্রি ভালো হওয়ায়ে এসব পিঠার দোকানিরাও বেশ খুশি।

প্রতি বছর শীতের আগমনে এ অঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর এক শ্রেণির নারী-পুরুষ পিঠা তৈরির সরঞ্জাম নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় পথের পাশে বসে পড়েন। কার্তিক মাস থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত চলে পিঠার ব্যবসা। এতে আয় রোজগারও ভালো হয়, আর সংসারও ভালো চলে। পুরুষ ও নারীরা এ পিঠা ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত। কারণ নারীরা পিঠা তৈরিতে পারদর্শী। এছাড়া নারীদের দোকানে ক্রেতাদের ভিড় ও বিক্রি বেশি। হরেক রকম ভর্তা দিয়ে চিতই পিঠার মজাটাই আলাদা। শীতের পিঠা বাঙালিদের জনপ্রিয় ও মুখরোচক খাবার।

শীত উৎসবের আমেজ বোঝা যায় রাস্তার মোড়ে মোড়ে বসা পিঠা বিক্রির বাহারি পসরা দোকান দেখেই। অলিতে গলিতে বসেছে পিঠা দোকান। চিতই পিঠার সঙ্গে হরেক রকমের ভর্তার সমারোহ এসব দোকানে।

দোকানি চুলা থেকে একেকটি পিঠা নামানোর সঙ্গে সঙ্গেই ছোঁ মেরে হাতে তুলে নেয়ার নিশ্চুপ প্রতিযোগিতা দেখা যায় ক্রেতাদের মধ্যে। গুড়, নারকেল ও চালের গুড়া দিয়ে তৈরি ভাঁপা পিঠা, পুলি পিঠাসহ বাহারি সব পিঠা তৈরি হয় এসব দোকানে। চিতই পিঠার সঙ্গে চিংড়ি, সুটকি ও ধনেপাতাসহ নানা রকমের সুস্বাদু ভর্তা জিহ্বায় জল এনে দেয়। অধিকাংশ পিঠা বিক্রেতারাই সারাদিন অন্য কাজ শেষে বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত পিঠা বিক্রি করে বাড়তি আয় করে সংসারের বাড়তি চাহিদা মেটাচ্ছে। পিঠা সহজেই হাতের কাছে পাওয়ায় সন্তুষ্ট ক্রেতারা আর বিক্রেতারা খুশি বেশি বিক্রি হওয়ায়।

পিঠা কিনতে আসা লিটন হোসেন বলেন, ‘‘বাড়িতে সব সময় পিঠা তৈরি করা সম্ভব হয় না। দোকানগুলোতে খুব সুন্দর ও সুস্বাদু পিঠা তৈরি করে। তাই প্রায় দোকান থেকে পিঠা খাই।”

সেরকম আরেক ক্রেতা শ্যামল চক্রবর্তী বলেন, ‘‘শীত মৌসুম এলে আমি প্রতিদিন সন্ধ্যায় বাজারের বিভিন্ন দোকানে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন পিঠা খাই ও পরিবারের সদস্যদের জন্য নিয়ে যাই।”

পিঠা বিক্রেতা সলেমান বলেন, ‘‘আমি সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কৃষিকাজ করি। বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত পিঠা বিক্রি করে দৈনিক ৫শ থেকে ৬শ টাকা লাভ করি।”

মাদারীপুর বিসিক নগরীর পিঠা বিক্রেতা চন্দ্রবান বলেন, “পিঠা বিক্রি করে আমার সংসার চলে। বর্তমানে বাজারে চিনি ও গুড়ের দাম বেশি তাই পিঠায় লাভ কম। সংসার চালাতে কষ্ট হয়।”

জেলার সর্বত্র ৫ শতাধিক ভ্রাম্যমাণ পিঠার দোকান রয়েছে। প্রতিটি দোকানে ২/৩ জন লোক পিঠা তৈরি ও বিক্রির কাজে থাকে। এতে কর্মসংস্থান হচ্ছে সহস্রাধিক মানুষের।

মাদারীপুর অঞ্চলে এটা মৌসুমী ব্যবসা। সারা বছর ভ্রাম্যমাণ পিঠার দোকান চলে না। তখন এসব মানুষ অন্য কোনো ব্যবসায় করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। এরা শিক্ষা-দীক্ষায় অনগ্রসর ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী।

লোকজ এ খাবার এক সময় আবহমান বাংলার সামাজিকতার অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু বর্তমানে সামাজিকতার ক্ষেত্রে পিঠার প্রচলন কমে এসেছে। পিঠা শুধু খাবার হিসেবে নয় বরং লোকজ ঐতিহ্য এবং নারীসমাজের শিল্প নৈপুণ্যের স্মারকরূপেও এর আবেদন ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আধুনিক নারীরা এখন পিঠা-পুলি তৈরি করে না বললেই চলে। আর এ কারণে বাংলার ঐতিহ্য পিঠা-পুলি এখন রাস্তা-ঘাট ও দোকানপাট থেকে কিনে খেতে হচ্ছে। তবে আধুনিক জীবনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রচলিত হয়েছে নতুন নতুন বাড়তি খাবার। বাজারে প্যাকেটজাত রকমারি মুখরোচক খাবারের সহজলভ্যতা পিঠার চাহিদা কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ বলে অনেকে মনে করছেন।

এখনো গ্রাম-গঞ্জের বৌ-ঝিয়েরা সারা বছর পিঠা তৈরি করে থাকেন। তবে কিছু পিঠা মৌসুমি। শীতকাল মূলত বাংলায় পিঠার মৌসুম। কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে ঘরে ঘরে নতুন ধান ওঠে। নবান্নের আনন্দে তৈরি হয় হরেক রকম পিঠা। খেজুরগাছের রস জ্বাল দিয়ে ঘন করে গুড় তৈরি করা হয়। দুধ ও খেজুর রসের সমন্বয়ে বানানো হয় রকমারী পিঠা।

আমাদের দেশে অনেক ধরনের পিঠে তৈরি হয়। সেসবের নাম ও আকার বিচিত্র রকমের। পরিচিত কয়েকটি পিঠার নাম হলো-পুলি, চিতই, বরা, পাতা, নারকেলি, মালফা, খেজুরি, ভাঁপা, রসপিঠা, পাটিসাপটা, ক্ষীরপিঠা, দুধপুলি ও চই প্রভৃতি।

এছাড়া বাহারি আরও অনেক নামের পিঠা আছে। এর মধ্যে অন্দশা এলোকেশি, চন্দ্রপুলি, দুধচিতই, দিলশাদ, ঝুরি, ফুলকুচি, পাকন, মাখনমালা, লাতকা, সন্ধ্যামনি, লবঙ্গ, খুশখেয়ালি, মৃগমোহিনী, রাঙাপুলি, জামাই পাগল, বাদশাভোগ, জামাইমুখ ও কন্যামুখ প্রভৃতি।

পিঠা তৈরি একটি শিল্পকর্ম। এমন কোনো বাঙালি নারী নেই যিনি কিছু কিছু পিঠা তৈরি করতে জানেন না। পিঠার কদর সমাদর ছিল আর আজও আছে। হয়তো বাঙালি এ ঐতিহ্য কোনোদিনই হারিয়ে যাবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *