Shadow

সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় ঐক্যের বিকল্প নেই

শহীদ উল আলম  :: বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) সাংবাদিকদের রেজিস্টার্ড সংগঠনগুলিকে নিয়ে গঠিত একটি বৈধ ফেডারেশন। এই সংগঠনের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে ফেডারেশনের চেয়ারম্যান ছিলেন জনাব কে জি মুস্তফা এবং আহবায়ক শ্রী নির্মল সেন। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত নির্বাচিত সভাপতি শ্রী নির্মল সেন আর মহাসচিব ছিলেন জনাব গিয়াস কামাল চৌধুরী (বর্তমানে তাঁরা সবাই প্রয়াত)।

চট্টগ্রামে সাংবাদিকদের দুর্দিনে বিএফইউজে নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন সময় চট্টগ্রাম ছুটে আসতেন এবং চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নকে সাথে নিয়ে সমস্যাসমূহ সমাধান করতেন।

চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সদস্যদের মধ্যে অতীতে একাধিকবার বিভাজন সৃষ্টি হয়েছিল। এ রকম একটি সময়ে, সম্ভবত ১৯৭৮-৮০ সালে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন শ্রদ্ধাভাজন আহমেদ হুমায়ুন (বর্তমানে প্রয়াত) এবং মহাসচিব ছিলেন শ্রদ্ধেয় রিয়াজ উদ্দিন আহমদ। এই দু’নেতা তৎকালীন সমস্যা সমাধানের জন্য চট্টগ্রাম আসেন। তখন সাংবাদিকদের এক গ্রুপ প্রেস ক্লাবে, অপর গ্রুপ দৈনিক বাংলার চট্টগ্রাম অফিসে (পুরাতন বিমান অফিস) অবস্থান নেন। দু’নেতা বিবদমান গ্রুপের সাথে বৈঠক করে চলমান সমস্যার সমাধান করে রাত্রি যাপনের জন্য হেঁটে লাভ লেইনস্থ হোটেলে যাচ্ছিলেন। মোমিন রোডের মধ্যবর্তী হেমসেন লেইন বরাবর আসলে হুমায়ুন ভাইকে জিজ্ঞাস করেছিলাম – আমরা যারা ছোট চাকুরি করি (প্রুফ রিডার বর্তমান সম্পাদনা সহকারী) তারা আন্দোলনে যেভাবে সোচ্চার থাকি সেভাবে সিনিয়ররা থাকেন না কেন? উত্তরে তিনি বলেছিলেন আন্দোলন করে ছোটরা আর ফল ভোগ করেন বড়রা- এটাই ইতিহাস। সাংবাদিকদের আন্দোলনতো এখন আর আগের মতো নেই। ২৪, ৪৮, ৭২ ঘন্টার অনশন নেই, জামালখান থেকে সদরঘাট পর্যন্ত মিছিলও নেই। লাগাতার ধর্মঘটের মতো কর্মসূচিও নেই। সাংবাদিক নেতারা ভুলে গেছেন চার্টার অব ডিমান্ড দেয়ার মতো আন্দোলনের সেই কর্মসূচির কথা। সংবাদপত্র মালিকদের লোভনীয় অফারের কাছে ইউনিয়নের প্রকৃত আন্দোলন আজ বাক্সবন্দী। এখন মালিকরা সাংবাদিকদের যে তালিকা দেন তাদেরই বেতন বৃদ্ধি হয়। সাংবাদিক নেতারাও মালিকের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে আত্মতৃপ্তি লাভ করেন। অথচ প্রায় প্রতিটি পত্রিকায় সাংবাদিক ইউনিয়নের সদস্যদের একটি অংশ ওয়েজবোর্ড নামের ন্যূনতম বেতন প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত বছরের পর বছর। তারপরও আমাদের সাংবাদিক নেতারা কিভাবে আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তোলেন তা বুঝি না।

৪র্থ, ৫ম এবং ৭ম ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়নে চট্টগ্রামে সাংবাদিকদের যে অর্জন ছিল সে অর্জন ৮ম-এ বিসর্জন দেয়া হয়েছে। ৭ম ওয়েজবোর্ডের সময় কোনো এক সাংবাদিক নেতা চুপিসারে মালিকের মানুষের সাথে বিজ্ঞাপন রেট এনে দেয়ার জন্য ঢাকায় গিয়েছিলেন এমন রটনা ছিল। ৮ম-এ এসে সাংবাদিক নেতারাতো মালিকের সাথে ‘বিমানে’ করে ঢাকায় গিয়ে ‘ঢাকা ক্লাবে’ রাত্রি যাপন করে মনিটরিং সেলের কর্মকর্তা ও নেতাদের ম্যানেজ করে বিজ্ঞাপনের রেট বৃদ্ধির ছাড়পত্র এনেছেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। নেতারা তাঁদের এই ভ্রমণকাহিনী ফেজবুকে দিতেও লজ্জাবোধ করেননি। কেউ কেউ আবার এ বিষয়টি নিয়ে লুকোচুরিও খেলছেন। অথচ যাঁদের ভোটে তিনি সাংবাদিক নেতা নির্বাচিত, তাঁরা যে তাঁদের ন্যায্য বেতন ভাতা এবং নিয়োগপত্র প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত সে কথা বেমালুম ভুলে গেছেন।

৭ম ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়নের প্রাক্কালে মালিকদের কাছ থেকে আদায় করা হয়েছিল নিয়োগপত্র। সেই নিয়োগপত্রে সংশ্লিষ্ট পত্রিকার ক্যাটাগরী উল্লেখ ছিল। এবার সাংবাদিক নেতারা একটিবারের জন্য সংবাদপত্র মালিকদের বলতে পারেননি কেন ইউনিয়নের সব সদস্যকে ওয়েজবোর্ডের আওতায় আনা হবে না এবং কি কারণে তাঁরা (মালিকরা) পত্রিকার ক্যাটাগরি নীচে আনবেন। এছাড়া মালিক/কর্তৃপক্ষের কাছে নিয়োগপত্র দেয়ার জন্যও কোনো দাবী তাঁরা করেননি। জিজ্ঞাস করতে পারেননি তাঁদের বাৎসরিক আয় কত? আর সংবাদপত্র প্রকাশ করতে গিয়ে তাঁদের মোট কত টাকা খরচ হচ্ছে ইত্যাদি। তাঁরা যাঁদের ভোটে নেতা হয়েছেন তাঁদের লাভালাভের চেয়ে মালিকদের লাভের বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন বেশি। দায়িত্ব নিয়েই তাঁরা হাওয়াই জাহাজে চড়ে বিদেশ ভ্রমণ করেছেন।

এতে করে কর্মরত সাংবাদিকদের কার কি সমস্যা তা দেখার সময় তাঁদের হয়নি। সাংবাদিক ইউনিয়ন নির্বাহী কমিটির সিদ্ধান্তকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে, পূর্বানুমতি না নিয়ে এবং বেতন কাঠামো নির্ধারণের জন্য গঠিত ফিক্সেশান কমিটির মতামতের তোয়াক্কা না করে মালিকবান্ধব সাংবাদিক নেতারা ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়নের নামে সংবাদপত্র মালিক কর্তৃপক্ষের ‘ইচ্ছাবোর্ড’ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সাংবাদিকদের যে ক্ষতি করেছেন তার খেসারত দিতে হবে পরবর্তীতে ওয়েজবোর্ড ঘোষণা হলে।

এখানে শুধুমাত্র পত্রিকার ক্যাটাগরী নীচে নামানো হয়নি। সাংবাদিকদের আদায়কৃত অধিকার বেতনস্কেলও নীচে নামানো হয়েছে। অথচ আইনে বলা আছে প্রাপ্ত/চলমান সুযোগ-সুবিধা কোনো অবস্থাতেই কমানো যাবে না।

চট্টগ্রামের একটি প্রাচীনতম দৈনিকের প্রবীণ সাংবাদিকরা চাকুরীজীবনের শুরু থেকেই মালিক কর্তৃপক্ষের প্রতি ছিলেন খুবই নতজানু । তাঁরা মনে করতেন বেতনবৃদ্ধির দাবি করলে তাঁদের চাকুরি থেকে বিদায় দিবে কর্তৃপক্ষ। সেজন্যে তাঁরা নবীন সাংবাদিকদেরও বেতন বৃদ্ধির বিষয়টি কর্তৃপক্ষ যেভাবে বলেন সেভাবে মেনে নিতে এক প্রকার বাধ্য করতেন। এতো তোষামোদির পরও কিন্তু মালিকের কাছে তাঁদের কারোরই শেষরক্ষা হয়নি। মালিক ঠিকই প্রয়োজন শেষে তাঁদের ছুঁড়ে মেরেছেন। অনেকক্ষেত্রে এসব প্রবীণ তথাকথিত সাংবাদিক নেতা এবং সাংবাদিকদের কারণে চট্টগ্রামে সাংবাদিকদের ন্যূনতম বেতন স্কেল বাস্তবায়ন করা দূরূহ হয়ে পড়েছিল। ইদানিং আবার যুক্ত হয়েছে মাঝবয়সী কতিপয় মালিকবান্ধব সাংবাদিক ও সাংবাদিক নেতা। এদের রাহুগ্রাস থেকে ইউনিয়নকে উদ্ধার করা না গেলে সাংবাদিকদের জন্য ওয়েজবোর্ড সোনার হরিণের মতো থেকে যাবে।

৮ম ওয়েজবোর্ডে মালিকের বাৎসরিক কথিত গ্রস আয়ের যে হিসাব লিপিবদ্ধ করা হয় তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য ছিল না। কারণ ৭ম ওয়েজবোর্ডে মালিকদের যে গ্রস আয় ৪ কোটি ছিল তা একলাফে অষ্টম ওয়েজবোর্ডে ২৫ কোটি এবং ২ কোটির স্থলে ১০ কোটি টাকা করা হয়েছে। ওয়েজবোর্ড ঘোষণার পরপরই চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী, তথ্যমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সব জায়গায় প্রতিবাদলিপি পাঠিয়েছিল। কিন্তু বিএফইউজে এই দাবিটিকে সঠিকভাবে সঠিক জায়গায় উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছে বলে আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে।

সাংবাদিক-কর্মচারীদের ন্যায্য পাওনা নিশ্চিত করার জন্য সরকার কর্তৃক গঠিত হয়েছে রোয়েদাদ বাস্তবায়ন মনিটরিং সেল। এই সেলে সরকার, মালিক ও শ্রমিক পক্ষের (অর্থাৎ সাংবাদিক-কর্মচারীদের দু’জন) প্রতিনিধি রয়েছেন। এছাড়া চট্টগ্রামে জেলা প্রসাশকের নেতৃত্বে রয়েছে অপর একটি মনিটরিং সেল। জেলা কমিটিতে সাংবাদিক-কর্মচারীদের দু’জন প্রতিনিধি আছেন। এত ‘চেকপোস্ট’ থাকার পরও কীভাবে সংবাদপত্র মালিকরা সাংবাদিক-কর্মচারীদের ন্যায্য পাওনা না দিয়ে বিজ্ঞাপনের রেট বৃদ্ধির ছাড়পত্র পান, তা বোধগম্য নয়। এখানে লক্ষ্যণীয় যে, আমাদের কতিপয় নেতা রহস্যজনক কারণে মনিটরিং সেলে থাকতে আগ্রহী বেশি । এমনি এক অবস্থায় মালিকরা তাঁদের ব্যবহার করে নিজেদের (মালিকদের) দীর্ঘদিনের মনের বাসনা পূরণ করতে সক্ষম হন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের কল্যাণে কাজ করতে খুবই আগ্রহী বলে আমার মনে হয়েছে। দীর্ঘসময় সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতৃত্বে থাকার সুবাদে তাঁর সাথে অনেকবার দেখা-সাক্ষাত এবং সম্মুখে বক্তব্য দেয়ার সুযোগ হয়েছে। চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সদস্যরা আমাকে এ সুযোগ করে দেয়ায় তাঁদের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ।
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি জনাব ইকবাল সোবহান চৌধুরী ও মহাসচিব জনাব আবদুল জলিল ভুঁইয়া’র নেতৃত্বে বিএফইউজে’র অংগ সংগঠনের নেতারা একসময় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করেন। উক্ত সাক্ষাৎ অনুষ্ঠানে আমরা তৎসময়ের সিইউজে এবং চট্টগ্রামের বিএফইউজে নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলাম। অঙ্গ ইউনিয়নের নেতারা সবাই সবার বক্তব্য শেষ করেছেন। বিএফইউজে সভাপতি-মহাসচিবও তাঁদের বক্তব্য সমাপ্ত করেছেন। এবার প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শুরুর পালা। হঠাৎ আমাদের মধ্য থেকে বিএফইউজের যুগ্মমহাসচিব সাংবাদিকদের রুটিরুজির আন্দোলনে সবসময়ে সোচ্চার কণ্ঠ সাইফুল ইসলাম তালুকদার বলে উঠলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমি কিছু কথা বলব। প্রধানমন্ত্রী তাঁকে সুযোগ দিলেন। তিনি শুরু করলেন এভাবে ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের জন্য অনেক কল্যাণমূলক কাজ করেছেন। সংস্কৃতিসেবীদের জন্য আপনি তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন ইতোমধ্যে একটি কল্যাণ ফান্ড করেছেন। আমি আপনার কাছে সাংবাদিকদের কল্যাণে ১০ কোটি টাকার একটি কল্যাণ ফান্ড গঠনের দাবী জানাচ্ছি’। বঙ্গবন্ধুকন্যা সাংবাদিকবান্ধব প্রধানমন্ত্রী সাথে সাথে তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদকে বললেন, আপনার মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আপাতত সাংবাদিকদের জন্য ১ কোটি টাকার একটি কল্যাণ ফান্ড গঠন করুন। সেই টাকা চলতি বছর থেকেই দেয়া শুরু হবে এবং তা রাজস্ব খাত থেকে দেয়া হবে। সাইফুল ইসলাম তালুকদার আজ আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তাঁর দাবীতে সৃষ্ঠ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত কল্যাণ ফান্ডের টাকা প্রদান অব্যাহত রয়েছে। তিনি সাদামাটা মানুষ ছিলেন। বড় কোনো পত্রিকায় চাকুরী না করলেও তাঁর মন ছিল বড় এবং তিনি ছিলেন সজ্জন ব্যক্তি। পরম করুণাময় তাঁকে জান্নাতবাসী করুন, এই কামনা করছি।

সাইফুল ইসলামের মৃত্যুর পর তাঁর পরিবার খুবই অর্থকষ্টে পড়ে যায়। তাঁর ২ মেয়ে ও এক ছেলে । বড় মেয়ে বিবিএ পাস করেছে। তাকে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায় একটি চাকুরী নিয়ে দেয়ার জন্য সাংবাদিক নেতাদের দ্বারে দ্বারে ধর্ণা দেন তাঁর সহধর্মিণী। বর্তমান সরকারের আমলে ঢাকার সাংবাদিক নেতাদের মধ্যে অন্তত: দু’জন নেতার ছেলে-মেয়ের চাকুরি হয়েছে বাসস-এ। তাঁরা কেউই কিন্তু সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্র বা ছাত্রী নন। মরহুম সাইফুল ইসলামের মেয়ে বাবার পেশাকে নিজের পেশা হিসাবে নিয়ে সাংবাদিকতা বিভাগে চাকুরী করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও সাংবাদিকের মেয়ে সাংবাদিকতা করবেন এমন মনোভাব পোষণ করেছিলেন। কিন্তু না, শেষ পর্যন্ত মেয়েটিকে বাসস-এর হিসাব শাখায় নিয়োগ দেয়া হয়েছে। হিসাব বিভাগে নিয়োগ দেয়ার পিছনেও কোন কোন সাংবাদিক নেতার কারসাজি ছিল বলে জনশ্রুতি আছে। কথায় আছে- রাখে আল্লাহ মারে কে? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গত রমজানে বিএফইউজে’র ইফতার মাহফিলে প্রধান অতিথি ছিলেন। ইফতার মাহফিলের আনুষ্ঠানিকতা শেষে তিনি নেতাদের নিয়ে যখন বৈঠকে বসেন তখন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শাবান মাহমুদ সাইফুল ইসলাম তালুকদারের পরিবারের অসহায়ত্বের কথাটি প্রধানমন্ত্রীর সামনে তুলে ধরেন। এসময় অনেক বাঘা বাঘা নেতার চেহারায় বিরক্তির ভাব লক্ষ্য করা গেছে বলে শোনা যায়। প্রধানমন্ত্রী গণমানুষের নেত্রী। তাঁর কাছে রয়েছে মানবতা ও মহানুভবতা। পরে প্রধানমন্ত্রী একদিন গণভবনে সাইফুলের পরিবারকে ডেকে নিয়ে যান এবং তাঁদের সব সমস্যার কথা শুনে সাথে সাথেই ২০ লক্ষ টাকার পারিবারিক সঞ্চয়পত্র করে দেন বলে জানতে পেরেছি। এই মহানুভবতার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চট্টগ্রামের সাংবাদিক সমাজের পক্ষ থেকে জানাই সশ্রদ্ধ সালাম ও কৃতজ্ঞতা।

লক্ষণীয় ব্যাপার এই যে, প্রথম দফায় সাংবাদিকদের এ সহায়তা তহবিলের টাকা হস্তান্তর অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আক্ষেপের সাথে বলেছিলেন, তালিকাতে তো সেই পুরনো চিনা চেনা মুখগুলো। এই টাকা প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের খেটে খাওয়া সাংবাদিকরাও যাতে পায় সেই ব্যবস্থা নিন। পরিতাপের বিষয় আমাদের সাংবাদিক নেতারা বিশেষ করে ঢাকার সাংবাদিকরা বড় বড় অংকের টাকা নিয়ে গেছেন এই ফান্ড থেকে। অথচ চট্টগ্রামের একজন সিনিয়র সাংবাদিক জনাব আ জ ম ওমর সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করলেও তাঁর পরিবারকে দেয়া হয়েছে মাত্র ৫০ হাজার টাকা। সরকার আসবে, সরকার যাবে। অবস্থা দেখে মনে হয় ঢাকার বাইরের সাংবাদিকদের ঢাকার মতো আনুপাতিক হারে কোনোদিন মূল্যায়ন হবে না।

এদিকে, প্রধানমন্ত্রী প্রদত্ত ২০ লক্ষ টাকার স্থায়ী আমানত ‘সাংবাদিক কল্যাণ ফান্ড’ এর অবস্থা আরো করুণ। এখানে পরিচালনা পর্ষদে যাঁরা আছেন তাঁরা অনুদান দেয়ার ক্ষেত্রে নিজেদের ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটান। এই তহবিলের টাকা শুধুমাত্র সাংবাদিকদের দেয়ার বিধান থাকলেও পরিচালকরা নিজ এলাকার পত্রিকা অফিসের একজন পিয়নকেও এক লক্ষ টাকা অনুদান দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। উক্ত সাংবাদিক কল্যাণ ফান্ডের আবেদন করতে হলে আবেদনকারীকে ঢাকায় গিয়ে সভাপতির কাছ থেকে ফরম সংগ্রহ করতে হয়। অথচ বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির যুগে এ ফরম অনলাইনে পাওয়ার কথা। অন্যদিকে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ‘বিশেষ সহায়তা তহবিল’ এর অর্থে ঢাকার অনেক সাংবাদিক এবং সাংবাদিক নেতার জীবনরক্ষা (চিকিৎসা) হলেও চট্টগ্রাম সহ ঢাকার বাইরের সাংবাদিকরা আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে সে সুযোগ থেকে অনেকটাই বঞ্চিত থাকছেন। সম্প্রতি চট্টগ্রামের একজন প্রবীণ ও ত্যাগী সাংবাদিক যিনি ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত তাঁর চিকিৎসা সহায়তার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহায়তা তহবিল থেকে অনুদান দেয়ার লক্ষে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের পক্ষ থেকে তথ্য উপদেষ্টার মাধ্যমে আবেদন করা হলেও এ পর্যন্ত কোনো অনুদান পাওয়া যায়নি।

পাকিস্তানী শোষণ বঞ্ছনার বিরুদ্ধে বাঙালিরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছেন। পাকিস্তানীরা চলে গেলেও এখনো ঢাকার বাইরের লোকদেরকে শোষণ বঞ্ছনার শিকার হতে হচ্ছে। এসব কিন্তু দেখার কেউ নেই। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা কল্যাণ তহবিলের প্রথম দফায় টাকা দেয়ার সময় যে উক্তিটি করেছিলেন, পরবর্তীকালেও সাংবাদিক নেতারা তাঁর সেই কথার মর্মার্থটা উপলব্ধিতে আনেননি। ফলে বরাবরের মতোই বঞ্চিত থেকে যাচ্ছেন ঢাকার বাইরের অসহায় সাংবাদিকরা।

এখন যাঁদের গাড়ি-বাড়ি আছে তাঁরাই পাচ্ছেন বেশি করে সহায়তা তহবিলের টাকা। আর ঢাকার সাংবাদিক হলেতো কথাই নেই। এছাড়াও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী, সচিব অথবা মন্ত্রণালয়ের কোনো ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তির আত্মীয় সাংবাদিক হলে তাঁদের কপাল আরো ভাল। এই সহায়তা তহবিলের শুরু থেকে এ পর্যন্ত যাঁদেরকে অনুদান দেয়া হয়েছে তাঁদের তালিকা পর্যালোচনা করলে উপরোক্ত অভিযোগের সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যাবে। তবে এ অবস্থা চলতে দেয়া যায় না, চলা উচিতও নয়।

একসময়ের সাংবাদিকদের শীর্ষনেতা শ্রদ্ধেয় নির্মল সেন একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান ছিলেন। তিনি ছাড়াও অতীতের অনেক নেতা রাজনীতির সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকলেও তাঁরা রাজনীতিকে সাংবাদিকতার সাথে গুলিয়ে ফেলতেন না। বর্তমানের সাংবাদিক নেতারা সরাসরি রাজনীতির সাথে জড়িত না থেকেও তাঁরা দলীয় লেজুড়বৃত্তির গন্ডি ছাড়তে পারছেন না। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন দেশের কর্মজীবী বৃহত্তর সাংবাদিক সমাজ। দেশে যে সব পেশাজীবী সংগঠনের অধিকাংশ নেতা-কর্মী সরাসরি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত এবং মন্ত্রী-এমপি হচ্ছেন সেসব সংগঠনের মূল প্ল্যাটফরমগুলো এখনো দ্বিখন্ডি হয়নি। যেমন আইনজীবী সমিতি, বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন(বিএমএ), ইঞ্জিনিয়ার্স এসোসিয়েশন বাংলাদেশ (আইইবি) ইত্যাদি। এছাড়া এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, চেম্বার সহ ব্যবসায়ীদের সংগঠনগুলো দলমতের উর্ধ্বে থেকে এখনো ঐক্যবদ্ধ। আজ সাংবাদিকদের মাঝে একজন ফয়েজ আহমদ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। অথচ স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে সাংবাদিকদের ভুমিকা ইতিহাসে বিশেষ একটি স্থান করে নিয়েছিল। সাংবাদিক নেতাদের হীন স্বার্থের কারণে আজ সেই গৌরব হারিয়ে ফেলেছে। যার কারণে বর্তমানে পেশাজীবী সাংবাদিকদেরকে প্রশাসন থেকে শুরু করে কোথাও তেমন কোনো গুরুত্ব দেয়া হয় না।

১৯৯৩ সালে সাংবাদিক ইউনিয়নসমূহ দ্বিখন্ডিত হবার পর থেকেই কর্মজীবী সাংবাদিকদের কপালে নেমে এসেছে দুর্ভোগ। উভয় গ্রুপের শীর্ষ নেতারা একে অপরের সাথে প্রায় সব বিষয়ে মিলেমিশে চলেন। এমনকি দ্বিখন্ডিত ইউনিয়নের নেতারা এক হয়ে ‘সাউথ এশিয়ান জার্নালিস্ট ফোরাম’ গঠন করে দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করলেও তাঁদের মধ্যে ভিন্ন মতের প্রকাশ ঘটে নি। সাংবাদিকদের রুটি রুজির সংগঠন সাংবাদিক ইউনিয়নকে এক করতে বলা হলে দলীয় লেজুড়বৃত্তির চেতনা জাগ্রত হয় উভয় গ্রুপের নেতাদের মধ্যে। আর এই সুযোগে অনেক পত্রিকার মালিক-সম্পাদক ইউনিয়নের সদস্য এবং নেতা হয়ে আছেন। তাঁদের সাথে দলীয় সরকারের সরাসরি যোগাযোগ থাকার কারণে নিজেরা বিভিন্নভাবে লাভবান হলেও দেশের বৃহত্তর সাংবাদিক সমাজ তাঁদের ন্যায্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো দ্বিখন্ডিত হবার পর থেকে সাংবাদিকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের দ্বি-বার্ষিক নির্বাচন গঠনতান্ত্রিক নিয়ম অনুযায়ী হয়নি। তাছাড়া আয়-ব্যয়ের সঠিক কোনো তথ্য নেই। বাৎসরিক কোনো অডিটও হয় না এ সংগঠনের। ফলে নেতারা যে যার মত করে টাকা আনছেন আর খরচ করছেন। ঢাকায় এ নিয়ে অনেক মুখরোচক কথাবার্তা হলেও দেখার কেউ নেই। কাউন্সিল অধিবেশনে এসব নিয়ে কথা হলেও নেতারা তা আমলে নেন না।

সাংবাদিক ইউনিয়ন বিভক্ত হওয়ার পর এই প্রথম গত ১০ অক্টোবর মঞ্জুরুল আহসান বুলবুলের নেতৃত্বে গঠিত নির্বাহী পরিষদ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছেন। আগামী ২৮ নভেম্বর এ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা রয়েছে। এজন্য মঞ্জুরুল আহসান বুলবুলকে আন্তরিক ধন্যবাদ।

বর্তমানে যাঁরা সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন তাঁরা অত্যন্ত সচেতন। সুতরাং এই সচেতন গোষ্ঠিকে নিজেদের অধিকার রক্ষার পাশাপাশি বৃহত্তর সাংবাদিক সমাজের ঐক্যের কথা ভাববার সময় এসেছে। নতুন প্রজন্মের সাংবাদিকরা সার্বিক দিক বিবেচনা করে পেশাগত স্বার্থকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে এগিয়ে আসলে সাংবাদিকতার মান-মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে। একই সাথে তাঁদের হারানো অধিকার ফিরে পাবেন বলে আমার বিশ্বাস।

লেখক:  চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি (এই লেখার মতামত সর্ম্পূণ লেখকের নিজস্ব, এর জন্য প্রয়াস নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *